
জুনায়েদ কামাল – ব্যুরো চীফ
চট্টগ্রাম নগরীর জিইসির মোড় এলাকায় হৃদয়বিদারক এক ঘটনা ঘটেছে। স্বামীর লোভ, মানসিক নির্যাতন ও পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এক গৃহিণী। নিহতের নাম আবিদা তাসমিন (৩২)। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার করমবক্স বাজারের পদুয়া মিয়া বাড়ি। তিনি চট্টগ্রামের চকবাজার থানাধীন এম এম আলীর রোডের ইসমাইল টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় বসবাস করতেন। তার স্বামী সাইফুদ্দিন মাহমুদ মারুফ (৩৮)-কে পুলিশ ইতিমধ্যে আটক করেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ০২ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে।
আবিদা তাসমিন মৃত্যুর আগে বলেন, তার মা তাকে চক বাজার থানাধীন এম এম আলীর রোডের পাশে এক কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনে দেন। কিন্তু তার স্বামী সাইফুদ্দিন মাহমুদ মারুফ ফ্ল্যাটটি তাকে লিখে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন করতে থাকে। পরে তাসমিন স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে তার বোনের শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। বোন ও ভগ্নিপতিকে সব খুলে বলেন।
ঘটনার দিন বিকেলে তাসমিন ও তার স্বামী মারুফের সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তাসমিন ঘর থেকে বের হয়ে বোনের বাসায় চলে যেতে চাইলে মারুফ বাধা দেয়। পরে তাসমিন রুম থেকে বের হয়ে ভবনের ছাদে চলে যায়, তাসমিনের সাথে তার স্বামী মারুফও ছাদে যায়। তাসমিন বাসা থেকে বের হতে পীড়াপীড়ি করলে মারুফ তাকে গেইট দিয়ে না গিয়ে ছাদের উপর দিয়ে যেতে বলেন। তাসমিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন সইতে না পেরে ছাদ থেকে লাফ দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, তাসমিন বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবনের নিচে পড়ে যান। স্থানীয়রা চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখতে পান তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় মূল গেইটের সামনে পড়ে আছেন। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, পরে পার্কভিউ হাসপাতাল, এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালের রেকর্ডে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে — “Brought in Dead / Fall from Height” (“উচ্চতা থেকে পড়ে মারা গিয়ে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে”)।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সাইফুদ্দিন মাহমুদ মারুফের সঙ্গে তাসমিনের বিয়ে হয়। প্রথম কয়েক বছর তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল স্বাভাবিক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কে আসে অশান্তি। জানা যায়, ইসমাইল টাওয়ারের যে ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন, সেটি ছিল আবিদা তাসমিনের নামে। বিয়ের পর থেকেই মারুফ ফ্ল্যাটটি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য স্ত্রীকে চাপ দিতে থাকেন। তাসমিন এতে রাজি না হওয়ায় গত দুই বছর ধরে পারিবারিক কলহ, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক চাপে ভুগছিলেন। পরিবারের কাছেও এই নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। প্রতিবেশীদের ভাষ্যমতে, প্রায়ই তাদের বাসায় ঝগড়ার শব্দ শোনা যেত।
ঘটনার দিন বিকেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরপর তাসমিন বলেন, তিনি পাশের ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই প্রতিবেশীরা তার দেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ৯তলা ছাদ থেকে লাফ দিয়েছেন।
ঘটনার পর চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-র নির্দেশে পুলিশের একটি চৌকস টিম অভিযান চালিয়ে স্বামী সাইফুদ্দিন মাহমুদ মারুফ-কে আটক করে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, এটি আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা মনে হলেও, ঘটনার পেছনে মানসিক নির্যাতন ও লোভের ভূমিকা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়রা জানান, তাসমিন ছিলেন শান্ত ও ভদ্র প্রকৃতির মহিলা। পারিবারিক সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগলেও কাউকে কিছু বলেননি। তারা ঘাতক স্বামীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন।
একটি সুখী সংসারের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে স্বামীর লোভ, অবিশ্বাস ও নির্যাতনের জটিল জালে। আবিদা তাসমিনের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, সমাজেরও এক গভীর সতর্কবার্তা—সম্পর্কে ভালোবাসার স্থলে যদি আসে লোভ ও জবরদস্তি, তবে এর পরিণতি হতে পারে জীবননাশী।