২০১৯ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে শুরু থেকে ফেভারিট ছিল ইংল্যান্ড। তাদের সঙ্গে সমান তালে লড়ে প্রথম শিরোপার স্বপ্ন দেখছিল নিউজিল্যান্ডও। এরপর শিরোপা নির্ধারণী ফাইনাল ম্যাচ ড্র হওয়ার পর সুপার ওভারেও কেউ কাউকে টপকাতে পারেনি। পরবর্তীতে বাউন্ডারির হিসাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় ইংল্যান্ডকে। সমান লড়াইয়ের পরও এমন সমীকরণে পিছিয়ে পড়ার হতাশা এখনো হয়তো তাড়িয়ে বেড়ায় কিউইদের। ৪ বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই আজ বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে ‘মধুর প্রতিশোধ’ নিল নিউজিল্যান্ড।
বিশ্বকাপজুড়ে রানের জোয়ার তৈরির আভাস মিলছিল প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই তিনশ রানের অধিক দলীয় সংগ্রহ এসেছিল। সেই তুলনায় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে কম সংগ্রহ-ই পায় ইংল্যান্ড। তাদের ২৮২ রানকে কোনো পাত্তাই দেননি নিউজিল্যান্ড ব্যাটাররা। ডেভন কনওয়ে আর রাচিন রবীন্দ্র- দুজনের সেঞ্চুরিতে ৮২ বল এবং ৯ উইকেট হাতে রেখে বিশাল জয় তুলে নিয়েছে কেন উইলিয়ামসনের দল।
ইংলিশদের রানতাড়ায় এক প্রকার ছেলে-খেলাই করছে দুই কিউই ব্যাটার কনওয়ে এবং রাচিন রবীন্দ্র। যা দুজনকেই রেকর্ডগড়া জোড়া সেঞ্চুরি এনে দিয়েছে। রাচিন রবীন্দ্র নিজের অভিষেক বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ম্যাজিক ফিগারের দেখা পেয়েছেন। তার আগেই কনওয়ে পেয়েছেন ওডিআই ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি। যার মধ্যে চারটি সেঞ্চুরি তিনি চলতি বছরে করেছেন। শেষ পর্যন্ত সেই সেঞ্চুরিকে ব্যক্তিগত দেড়শ রানে নিয়ে গেছেন কনওয়ে। মাত্র ৮৩ বলেই সেঞ্চুরি করেছেন কনওয়ে। যা চলতি বিশ্বকাপের প্রথম কোনো ব্যাটারের সেঞ্চুরি।
জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার সময় কনওয়ে অপরাজিত ছিলেন ১৫২ রানে। ৩২ বছর বয়সী এই বাঁ-হাতি ব্যাটার ১২১ বলের ইনিংসটি ১৯টি চার ও তিন ছক্কায় সাজিয়েছেন। এছাড়া রবীন্দ্র ম্যাজিক ফিগার পূর্ণ করেছেন ৮২ বলে। শুরু থেকে তিনিই বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন। এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৯৭ রান করে দারুণ কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন ২৩ বছর বয়সী এই ব্যাটার। উদ্বোধনী ম্যাচে রবীন্দ্র ৯৬ বলে ১১টি চার ও পাঁচ ছক্কায় ১২৩ রানে অপরাজিত ছিলেন।
ত্রয়োদশ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই ইতিহাসের অনন্য নজির দেখলো ক্রিকেটবিশ্ব। কনওয়ে-রবীন্দ্র ২৬২ রানের জুটি গড়েছেন। যা নিউজিল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সবোচ্চ রানের রেকর্ড। এর আগে সর্বোচ্চ ২০৩ রানের জুটি ছিল মার্টিন গাপটিল ও উইল ইয়াংয়ের। সেই ইয়াংও আজকের ম্যাচে ওপেন করেছেন।
তবে তার উইকেট দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা করেছিল ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ওভারে স্যাম কারানের প্রথম বলেই ইয়াং আউট হয়েছেন বাটলারকে ক্যাচ দিয়ে। ফলে রানের খাতাও খুলতে পারেননি তরুণ এই ওপেনার। এরপর শুরুর ধাক্কা পরবর্তী দুই ব্যাটার কিভাবে সামলেছেন—সেটি বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
ইংলিশ বোলারদের জন্য আজকের দিনটি বিভীষিকাময়-ই বলা চলে। সেভাবে তারা উইকেটের সম্ভাবনাও জাগাতে পারেননি। প্রায় তিনশ ছোঁয়া ম্যাচও কিউইরা যেভাবে ৮৩ বল হাতে রেখে জিতেছে—তা দেখেই তাদের ইকোনমি টের পাওয়া যায়। ডিফেন্ডিং বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হয়ে একমাত্র উইকেটটি নিয়েছেন স্যাম কারান।
এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াই মাঠে নামে বিশ্বক্রিকেটের দুই পরাশক্তি দল। যেখানে টস জিতে আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন কিউই অধিনায়ক টম ল্যাথাম। আগেই শোনা গিয়েছিল, নিয়মিত অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন ও টিম সাউদিকে ছাড়াই নিউজিল্যান্ডকে প্রথম ম্যাচ খেলতে হবে। অন্যদিকে, চোটের কারণে ইংল্যান্ড দলে নেই বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক অলরাউন্ডার বেন স্টোকস।
ম্যাচের শুরুটা অবশ্য খারাপ ছিল না ইংলিশদের। ওভারপ্রতি প্রায় ৬ গড় নিয়ে শুরু থেকেই জস বাটলারের দল রান তুলছিল। দ্বিতীয় বলেই ছয় হাঁকিয়ে রানের খাতা খুলেন জনি বেয়ারস্টো। ট্রেন্ট বোল্টের প্রথম ওভারে আসে ১২ রান। অপরপ্রান্তে তার ওপেনিং সঙ্গী ডেভিড মালান রান পেতে কিছুটা হিমশিম খেয়েছেন। যার ধারাবাহিকতায় চাপে পড়ে কিউই পেসার ম্যাট হেনরির করা ইনিংসের অষ্টম ওভারে তিনি পা হড়কান। উইকেটরক্ষক টম ল্যাথামকে তিনি ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ১৪ রানে (২৪ বল)।
এরপর থেকে ইংলিশদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফলাতে শুরু করেন বাঁ-হাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনার। যা তিনি পুরো ইনিংসজুড়ে ধরে রেখেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে খেলতে থাকা বেয়ারস্টোকে নিজের প্রথম শিকার বানান স্যান্টনার। তার বল লং অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন ড্যারিল মিচেলের হাতে। তার আগে ৩৫ বলে ৩৪ রান করেন বেয়ারস্টো। এরপর সেই ধাক্কা সামলে ইংলিশদের স্বপ্ন দেখাতে থাকেন হ্যারি ব্রুক ও রুট। স্বাভাবিক মেজাজে খেলতে থাকা রুটের অপরপ্রান্তে ব্রুক আগ্রাসী মেজাজে ব্যাট চালাতে থাকেন। কিন্তু সেই মনোভাবই কাল হলো তার। রাচিন রবীন্দ্র’র বলে দু’টি চার এবং একটি ছক্কা মারার পরের বলেই আবার বড় শট খেলতে গিয়ে ব্রুক উইকেট দিয়ে বসেন। ২৫ রান (১৬ বল) করে তিনি তালুবন্দি হন ডেভিড কনওয়ের।
ম্যাচে মাত্র তিন ওভারের জন্য আক্রমণে এসেছিলেন অনিয়মিত বোলার গ্লেন ফিলিপস। এর ভেতরই তিনি গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট নেন, প্রত্যেকটিই আবার বোল্ড। তার প্রথম শিকার মঈন আলি। মাত্র ১১ রানেই ইংলিশ অলরাউন্ডার ফিলিপসের বলে নিজের স্টাম্প হারান। দলীয় ১১৮ রানেই ৪ উইকেট হারানো ইংলিশদের বড় সংগ্রহের স্বপ্ন তখন শঙ্কায় পড়ে যায়। তবে স্বপ্ন জোড়া লাগানোর চেষ্টায় নামেন অধিনায়ক বাটলার ও রুট। দুজনে মিলে জুটি গড়েন ৬০ রানের। এর ভেতর রুট ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৭তম ফিফটি তুলে নেন।
তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে থাকা বাটলারও হাঁটতে থাকেন ফিফটির পথে। দুটি করে চার-ছয়ে একশ স্ট্রাইকরেটও ধরে রাখেন ইংলিশ অধিনায়ক। ম্যাট হেনরির করা কিছুটা লাফিয়ে ওঠা বল খেলতে গিয়ে বাটলারের ব্যাট ছুঁয়ে যায় কিপারের হাতে। ফলে ৪৩ রানেই (৪২ বল) থামে তার ইনিংসটি। এরপর লিয়াম লিভিংস্টোন ও রুট আউট হয়ে যান অল্প সময়ের ব্যবধানে। লিভিংস্টোন ২০ রানে আউট হন বোল্টের বলে। ফিলিপসকে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান রুট। তার আগে তিনি ৮৬ বলে চারটি চার ও এক ছক্কায় ৭৭ রানের ইনিংস খেলেন।
তার বিদায়ের পর আর কেউই সেভাবে ইংল্যান্ডকে আশা দেখাতে পারেনি। ক্রিজে থিতু হতে পারেননি স্যাম কারানও। শেষদিকে আদিল রশিদের ছোট্ট ক্যামিওতে ইংল্যান্ড লড়াইয়ের পুঁজি পায়।
কিউইদের হয়ে সর্বোচ্চ তিনটি উইকেট পান ম্যান হেনরি। মিতব্যয়ী বোলিংয়ে স্যান্টনার নেন দুই উইকেট। এছাড়া ফিলিপস দুটি এবং একটি করে শিকার করেছেন বোল্ট ও রবীন্দ্র।