এনামুল হক আরিফ
ব্যুরো চিফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আধিপত্যের লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ চার, মারা গেল তরুণ শিপন
রবিবার সকালটা অন্য দিনের মতো ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের থোল্লাকান্দি গ্রামে হাহাকার আর শোকের ছায়া। রাস্তাজুড়ে নিস্তব্ধতা, দোকানের সাটার নামানো, বাতাসে এখনো ধোঁয়াটে আতঙ্কের গন্ধ। কারণ, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই এই গ্রাম কেঁপে উঠেছিল গুলির শব্দে।গতকাল রাতের সেই দুঃসহ ঘটনাটি আজও সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।গনি শাহ মাজার সংলগ্ন ছোট্ট এক রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়েছিলেন শিপন মিয়া (৩০) — নুরজাহানপুর গ্রামের মনেক মিয়ার ছেলে। কেউ জানত না, সেটাই হবে তার জীবনের শেষ রাত।শেষ খাবার, শেষ নিশ্বাস,রেস্টুরেন্টের প্লেটে তখনও ভাত ও ডাল অর্ধেক পড়ে ছিল— ঠিক সেই সময় গুলির শব্দ ছুটে আসে।“বাঁচাও, গুলি করছে!”— এমন আর্তচিৎকারে মুহূর্তেই অন্ধকারে লুটিয়ে পড়েন শিপন।
সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হন হোটেলের কর্মচারীসহ আরও তিনজন। স্থানীয়রা রক্তে ভেজা শরীরগুলো টেনে নিয়ে যান সড়কের পাশে।
রাতের নরম আলোয় চারদিকে শুধু মানুষের ছুটোছুটি আর আহাজারি।শিপনের ছোট বোনের জামাই ও মামাতো ভাই শাকিল মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখি— শিপন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যাই, ডাক্তার বলেন— অনেক রক্ত গেছে, কিছু করার ছিল না!”আধিপত্যের লড়াই, থেমে নেই মৃত্যু
স্থানীয়দের ভাষায়, “থোল্লাকান্দি মানেই আধিপত্যের রাজনীতি।”
বছরের পর বছর ধরে এখানে দুই পক্ষের দুষ্কৃতকারীদের মধ্যে চলে আসছে ক্ষমতা আর প্রভাবের লড়াই।প্রতিবারই প্রশাসনের আশ্বাস এসেছে, কিন্তু কখনো বাস্তবে পরিবর্তন আসেনি।
গতরাতে সেই চিরচেনা বিরোধই রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে।
একপক্ষের অভিযোগ— রিফাত বাহিনীর লোকজনই পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে।অন্যদিকে, অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ— শিপন নিজেই আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছিল। “যে হাসত, আজ সে নেই...”আজ সকালে শিপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।আঙিনায় ভেসে বেড়াচ্ছে কান্নার শব্দ—মা নেই, বোনের চোখ শুকিয়ে গেছে কান্নায়।গ্রামের মানুষজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। কেউ কারও দিকে তাকাতে পারছে না।
শিপনের ঘরের দেয়ালে ঝুলছে তার একসময়কার স্কুলজীবনের ছবি— হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত মুখ।
কেউ জানত না, আধিপত্যের রাজনীতির গুলিই কেড়ে নেবে সেই হাসি।পুলিশের বক্তব্য
এ বিষয়ে নবীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শাহিনুর ইসলাম জানান,
“গুলিবর্ষণের খবর পেয়ে দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে।”
তিনি আরও বলেন, জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।জনমনে প্রশ্ন,প্রশাসনের এই “অপেক্ষমাণ নীরবতা” এখন জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।অনেকেই বলছেন— “বছরের পর বছর একই নাটক, একই আশ্বাস; কিন্তু শেষমেশ লাশই পড়ে থাকে।”থোল্লাকান্দি আজ শুধু একটি গ্রামের নাম নয়—এটি এখন এক তরুণ প্রাণের নিভে যাওয়া আলো,এক মায়ের বুকফাটা কান্না,আর এক সমাজের প্রশ্ন—
“কবে থামবে এই রক্তের খেলা?”