
হাফিজুর রহমান গাজীপুর
চোখে মোটা চশমা, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, মনটা ভর্তি স্বপ্ন—তবু প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধা কলেজে ঢোকার মুহূর্তটা এক বিভীষিকার নাম। গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকায় অবস্থিত এ কলেজের নামের মধ্যে যতটা মর্যাদা, গেটে পা রাখতেই ততটাই অপমান যেন চেপে বসে নাকে-মুখে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশজুড়ে যতদূর চোখ যায়—শুধুই আবর্জনার স্তূপ, দুর্গন্ধে ভারী বাতাস, মশা-মাছির উত্থান-পতনের মহোৎসব। এমন নয় যে কেউ দেখছে না; বরং সবাই দেখেও না দেখার ভান করে আছে। চারপাশে অসংখ্য কারখানা, হাজার হাজার ভাড়াটিয়া, তাদের ফেলা গৃহস্থালি বর্জ্য, বাজারের পচা সবজি—সবকিছু এসে কলেজের দোরগোড়ায় গড়ে তুলেছে এক নরকদৃশ্য। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে কষ্ট, চোখে বেদনা—তামান্না আক্তার বলে, “প্রতিদিন মনে হয় ময়লার ভাগাড়ে ঢুকছি।” অথচ ওর কাঁধে বই, স্বপ্ন—ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।
এই পরিস্থিতির জন্য কেউ সরাসরি দায় নিচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ বলছে ব্যবস্থা নিচ্ছে, অথচ বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। বেসরকারি ময়লা সংগ্রাহকরা ৫০-১০০ টাকায় ভাড়াটিয়াদের বর্জ্য এনে ফেলছে রাস্তায়, কেউ থামায় না, কেউ দেখে না। বাড়িওয়ালারা ভাড়া তো নেন ঠিকই, কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেলায় নীরব দর্শক। ছাত্ররা ক্লাসে বসে পড়তে পারে না, দুর্গন্ধে মাথা ঘোরে, শিক্ষকদের মনোযোগও হালে পানি পায় না। অভিভাবকরা ভয়ে সন্তানকে কলেজে পাঠান, আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরাসরি বলছেন—এই অবস্থা থাকলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, এমনকি কলেরা পর্যন্ত ছড়াতে পারে।
এ যেন এক অসম যুদ্ধ—শিক্ষার্থীদের চেষ্টার বিরুদ্ধে পরিবেশের অবজ্ঞা। কলেজের প্রধান গেটই যদি শিক্ষার শত্রুতে পরিণত হয়, তাহলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে? ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলছেন, অভিযোগ করা হয়েছে, অথচ এখনও চোখের সামনেই জমছে ময়লার স্তূপ। ইউপি চেয়ারম্যান বলছেন, আগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এখন আবার হবে—কিন্তু সেই “হবে” কবে হবে কেউ জানে না। নির্বাহী কর্মকর্তা জানেন না এমন কিছু ঘটছে, অথচ শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন দম বন্ধ করা বাতাস গিলে ক্লাসে যায়।
এ এলাকায় যেন শব্দে শব্দে, গন্ধে গন্ধে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় প্রতিদিন স্বপ্ন খুন হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি ময়লার ভাগাড়ে রূপ নেয়, তাহলে সেই চেতনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এখনই সময়, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী সবাই মিলে এই বিভীষিকা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। না হলে একদিন শিক্ষার্থীরা কেবল কলেজে নয়, জীবনেই ঢুকবে এক দীর্ঘস্থায়ী ভাগাড়ে।