
এবাদুল হোসেন
একসময় এই খাল ছিল জীবনরেখা। চরপাথর ঘাটা থেকে শুরু করে শিকলবাহা, জুলদা, চরলক্ষ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরের কোলে পৌঁছে দিতো কর্ণফুলীর বুকে চলা জলযানগুলোকে। মাঝির হাঁকে মুখর হতো দুপাড়, বর্ষার পানিতে ভেসে চলতো কৃষকের স্বপ্ন। এই চরফরিদ খালই ছিল এক সময়ের পূর্ব-দক্ষিণ চট্টগ্রামের নদী-নির্ভর জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস।
কিন্তু আজ?
আজ সেই খাল খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুধু কোথাও কোথাও দেখা মেলে তার কিছু কঙ্কালসদৃশ রেখা—যা বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের ছায়ায় হারিয়ে গেছে।
এক সময় যেখানে কেবল পানি আর স্রোতের খেলা ছিল, সেখানে আজ বিরিয়ানি হাউজ, মোবাইল মার্কেট আর বহুতল ভবনের জঞ্জাল। খাল ভরাট করে বানানো হয়েছে দোকান, ঘর, গ্যারেজ—আর নাম দেওয়া হয়েছে “ড্রেন”। হাঁ করে তাকিয়ে থাকা সেই ড্রেনের পাশেই দাঁড়িয়ে রাঁধা হয় বিরিয়ানি, আর জলপথে ভেসে চলে পলিথিন, আবর্জনা আর রোগের জীবাণু।
চুপিচুপি, কিন্তু পরিকল্পিত!
কোনো এক সময়, রাতের আঁধারে অথবা দিনের আলোর মধ্যেই, দখল শুরু হয়। একপাশে মাটি ফেলা, আরেক পাশে পিলার বসানো। তারপর দোকান—ভাড়া উঠতে থাকে ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায়। এক দোকানদার জানান, তিনি না জেনেই এই খালের জায়গায় দোকান ভাড়া নেন। কথিত এক ‘জমিদার’-এর কাছ থেকে মাসে ৮ হাজার টাকায় ভাড়া নিলেও, এখন দিতে হয় প্রায় ২০ হাজার। মাসে জরিমানা দিলে, জমিদার নেন ডাবল—বলে, “সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়!”
আর এভাবেই একদিন, পুরো খালটাই হয়ে গেল ‘ভাড়ার সম্পদ’।
শুধু খাল নয়, হারিয়েছে একটা জীবনধারা
চরফরিদের এক প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, “খাল তো এখন কই! খাল আছিল, এখন বিল্ডিং। পানি নামার জায়গা নাই। দাঁড়ায়া থাকে।”
এই দাঁড়িয়ে থাকা পানি জন্ম দেয় ডেঙ্গুর, সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা, অচল করে দেয় সড়ক। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চরফরিদ খাল হারানো মানে শুধুই একটি খাল নয়—এটা একটি অঞ্চলভিত্তিক বসবাসযোগ্য নগরের পরিকাঠামোকে হারিয়ে ফেলা।
যেখানে একদিন চলত নৌযান, সেখানে এখন কেবল হাঁটা যায় নাক চেপে ধরে।
প্রশাসন বলছে ব্যবস্থা নিচ্ছে...
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব কান্তি রূদ্র জানিয়েছেন, “আমরা খাল ও প্রকৃতি উদ্ধারে দ্রুতই ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
তবে স্থানীয়রা বলছেন—বছরের পর বছর ধরে যে খালকে মেরে ফেলা হয়েছে, সেই মৃত্যু কি শুধু অভিযানে ঘুরে দাঁড়াবে?
এখানে প্রশ্ন ওঠে— এই উন্নয়ন কাদের জন্য?
খাল মুছে দিয়ে বানানো এই বহুতল ভবন কি সত্যিকারের অগ্রগতি?
নাকি, এটা এক নির্লজ্জ প্রতারণা—প্রকৃতির সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে, আর মানুষের অধিকার নিয়ে?
এখনো সময় আছে, যদি আমরা চাই
চরফরিদ খাল হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার গল্প এখনো আছে।
তার বুক ভরে আছে মাঝিদের স্মৃতি, পল্লির সুর, আর জলজ জীবনের করুণ এক আর্তনাদ।
এই খালকে যদি বাঁচানো যেত, তাহলে বাঁচতো এক ইতিহাস।
বাঁচতো পরিবেশ, বাঁচতো মানুষ।
আর এখন?
চরফরিদ খাল নেই—আছে স্মৃতি, ক্ষোভ, আর প্রশ্ন।
প্রশ্নটা এখনও সময়মতো করা যায়:
আর কতটা হারালে আমরা জাগবো?