
বাংলাদেশ সেনা বাহিনী আলীকদম জোনের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে পাল্টে দিয়েছে লামা-আলীকদমের চিত্র। অনেক অনিয়মের ভিত্তিমূলেও আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ সেনা বাহিনী আলীকদম জোনের তত্ত্বাবধানে লামা-আলীকদমের লক্ষাধিক বাঙ্গালী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কল্যাণ সাধিত হচ্ছে। প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকা থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড সমুলে নির্মূল, অবৈধ কাঠ, বাঁশ পাচার রোধ, বিগত দিন থেকে কোটি কোটি টাকার কাঠ আটকে আলীকদম জোনের সেনা কার্যক্রম অনেক প্রশংসা অর্জন করেছে। তাছাড়া পাহাড় খুঁড়ে পাথর আহরণ বন্ধ, তামাক কিউরিং-এ পরিবেশ বান্ধব কার্যক্রমসহ সরকারী-বেসরকারী সকল প্রশাসনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে সেনা বাহিনী। এলাকায় সড়ক নির্মাণ, ব্রীজ-কালভার্ট স্থাপনসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উনয়নে সেনাবাহিনী নগদ অনুদান প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে। শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক কার্যক্রমে সহায়তা, চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম, উদ্যান উন্নয়ন, বৃক্ষরোপন, এতিমখানা-অনাথালয়ে আর্থিক সহায়তা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে অনুদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, মৈত্রী কার্যক্রমের আওতায় প্রেসক্লাব নির্মাণ, বিভিন্ন স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানার শিক্ষকদের বেতন ভাতা প্রদান, পাহাড়ী দুর্গম পল্লীগুলোতে ন্যায্যমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী প্রদান করে যাচ্ছে সেনা বাহিনী।
তাছাড়া প্রত্যান্ত এলাকার রোগাক্রান্ত উপজাতি ও অউপজাতিদেরকে উন্নত চিকিৎসা প্রদানে দ্রুত যোগাযোগে সহায়তা দিয়ে আসছে সেনা বাহিনী। বিগত দিনে আলীকদম জোনের সহায়তায় লামা বন বিভাগ কোটি কোটি টাকা মূল্যের বনজ সম্পদ অবৈধ পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার করে রাজস্ব বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন আর্মি।
২০০৫ সালে আলীকদম উপজেলার কানামাঝি ঘাট এলাকার মিরিঞ্জা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শুক্রাপাড়ায় একটি সন্ত্রাসী আস্তানায় অভিযান চালিয়ে আলীকদম জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মোঃ আজিম উলল্লাহ বাহার, পিএসসি’র নেতৃত্বে একটি সি টাইপ সেনা টহল দল ১টি একে-৪৭ ও ১টি এম-১৬ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জমাদি উদ্ধার করেছিল। তার পাঁচদিন পর জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর নাহিদুল ইসলাম খাঁন, পিএসসি ও ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে ৫টি একে-৪৭ রাইফেল ও ৩ হাজার রাউন্ড গুলিসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে সেনা বাহিনী। ওই দু’টি অভিযানে রকেট লাঞ্চার, মটার সেল, এ্যান্টি পার্সোনাল মাইন, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ নানা সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছিল। একই বছর লামা উপজেলার লুলাইন এলাকা থেকে সেনা বাহিনী দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে ৩টি হাতিসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ কাঠ উদ্ধার করেন। আলীকদম জোনের সহায়তায় লামা বন বিভাগের মাতামুহুরী রেঞ্জের বিরানপ্রায় বিশাল বনাঞ্চলের বৃক্ষ নিধনও সেনা বাহিনীর নিভিড় নজরদারির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। লামা বনবিভাগের বমু রিজার্ভেও সেনা তৎপরতায় উজাড় প্রক্রিয়া বন্ধ হয়। হালনাগাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সন্ত্রাসীদের অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে এ ধরণের ছোট-বড় অনেক সফলতা রয়েছে।
২০১৭ সালে লামা উপজেলার দূর্গম রুপসিপাড়া ইউনিয়নে চাঁদাবাজ সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সংঘর্ষে এক সন্ত্রাসী নিহত হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অস্ত্র ও গোলাবারুদ। জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মাহবুবুর রহমান পিএসসি এর সার্বিক দিকনির্দেশনায় তৎসময় আলীকদম জোনের রুপসিপাড়া ক্যাম্প ইনচার্জ সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আক্তার-এর নেতৃত্বে একটি চৌকস সেনা টহল ওই অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এর আগে ২০১৬ সালে রুপসিপাড়া ইউনিয়নের অংহ্লাপাড়ার বাসিন্দা কলা ব্যবসায়ি বসন্ত বড়ুয়া নাইক্ষ্যংমুখ এলাকায় কলা কিনতে গিয়ে সন্ত্রাসীদেরদ্বারা খুন হয়েছিল। সেনাবাহিনীর ওই একই চৌকস টহলটি নিহত ব্যবসায়ির লাশ উদ্ধার ও হত্যাকারী ৩ জনকে দুর্গম নাইক্ষ্যংমুখ এলাকায় থেকে আটক করতে সক্ষম হন। হত্যার সাথে জড়িত তিন সন্ত্রাসীকে বিচারের আওতায় জেল দেয়া হয়।
এছাড়া লামা উপজেলার দূর্গম এলাকাগুলোতে নিরাপত্তায় আলীকদম জোন সচেষ্ট রয়েছেন। লামার গয়ালমারা সন্ত্রাসী এলাকায় বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজিসহ পরিবেশ বিপন্নকারী পাথর আগ্রাসীদের অপতৎপরতা বন্ধ করেন। এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় আলীকদম জোন তাদের নিয়মিত অপারেশনাল কর্মকান্ড’র পাশাপাশি সিভিল প্রশানকে সর্বাত্বক সহায়তা করে চলছেন। এর ফলে জনগণের জানমাল হেফাজত হচ্ছে, রক্ষা পাচ্ছে সরকারি সম্পদ।
২০১৫ সালে এমএনপি’র ৪২ সদস্যস্যের একটি সশস্ত্র সংগঠনকে সেনাবাহিনীর আলীকদম জোনের পোয়ামুহুরী ক্যাম্পে আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হন। পরে আরেক অভিযানে একই বছরের ৮ মে পোয়ামুহুরী ইয়াংরিং মুরুং কার্বারীপাড়া থেকে ৭টি গাদা বন্দুক, একটি পিস্তল, গান পাউডার ৩০০ গ্রাম, বল্লম/ছোরা ৮টি, গানপাউডার তৈরির কেমিক্যাল, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ এমএনপি সদস্য সন্দেহে সাত মুরুংকে আটক করেছিল। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এর আগে নিহত এমএনপি প্রধান মেনরুম মুরুং লাশের সন্ধান পায়। পরে পোয়ামুহুরীর মেনচিংপাড়ার দুর্গম অরণ্য থেকে নিহত মেনরুমের মাটিচাপা লাশের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নিহত হওয়ার পর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংগঠনটির সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ককুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী এলাকায় মেনরুম (ছোট) গ্রুপ ও দোছরী-তৈনখাল এলাকায় লৌহব গ্রুপ নামে এ দুই অংশের পরিচয় পায়। এই দুই গ্রুপ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় করত। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর/১৫ মোহাম্মদ আলী ও মো: সাইফুল ইসলাম নামে দুই ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে এমএনপি সন্ত্রাসীরা।
অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে সেনাবাহিনীর আলীকদমদম জোন এমএনপি বিরোধী অভিযান চালায়। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান, নানামূখী কৌশল অবলম্বন করেন। অবশেষে সন্ত্রাসীদের আর্থিক সঙ্কট, নিজ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অসহযোগিতাসহ নানামুখী টানাপড়নে সংগঠনটির সদস্যরা আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
**
এর ফলে সংগঠনটির মেনরুম গ্রুপের ৬৪ জন ও লৌহব গ্রুপের ১৪ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তারা ৬০টির মতো স্থানীয় তৈরি অস্ত্রও জমা দেয়। এদের অপতৎপরতায় অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর পাশাপাশি খোদ ম্রো জনগোষ্ঠীর সদস্যরা চিন্তিত ছিল। কেউই চাননি তাদের সন্তানেরা বিপথগামী হোক। পরে ম্রোদের সামাজিক সংগঠন ম্রো সোস্যাল কাউন্সিল বিপথগামী যুবকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়।
অপরদিকে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ইঞ্জিয়ার দল ১৭ ইসিবি আলীকদম-থানচি সড়কের নির্মাণে ৩০ কি:মিটার রাস্তার কাজ সম্পন্ন করে। থানচির সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজ উপায় করে দেয়। এ রাস্তার ফলে এতাদাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এর আগে ১৯৮০-৮৭ সাল নাগাদ বর্তমান লামা-আলীকদম-ফাঁসিয়াখালী ৪৪ কি: মিটার সড়ক নির্মাণ করেছিল ইসিবি। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্মাণ ব্যাটালিয়ন ১৭ ইসিবি আলীকদম পোয়ামুরি সড়ক নির্মাণ করেন। একই সময় মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গনরোধে সেনানিবাস এলাকায় ব্লক বসানোর কাজ সম্পন্ন করেন।
বর্তমান জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল শওকত মোনায়েম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধিন ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড এর নির্দেশনায় জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যানে কাজ করছেন। যে কোন ধরণের দুর্যোগকালীন সময়ে পরম বন্ধু হয়ে স্থানীয়দের পাশে এসে দাড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আলীকদম জোন। সম্প্রীতি, উন্নয়ন, নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জনগোষ্ঠীর জীবনানুকুল ভূমিকা রাখছেন।