
মো.দিদারুল আলম- চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অংশে মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে, এক বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় তিন-চার গুণ। তাছাড়া দুর্ঘটনায় আহতদের সংখ্যাও অনেক। কিন্ত একই সময়ে কিছুটা কমেছে দুর্ঘটনা। ফায়ারসার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুসারে সড়ক দুর্ঘটনার এ চিত্র দেখা যাচ্ছে।
কোনো দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত ও আহতদের তথ্য সংরক্ষণ করে ফায়ার সার্ভিস। কিন্ত হাসপাতালে নেওয়ার পর কেউ মারা গেলে সে হিসাব ফায়ারসার্ভিসের আওতায় থাকেনা। তবে হাসপাতাল থেকে কোনো লাশ বুঝে নিতে হাইওয়ে পুলিশের ছাড়পত্র নিতে হয়, তাই মৃত্যুর হিসাব হাইওয়ে পুলিশের কাছ থেকে নিতে হয়।
সরেজমিনে ফায়ার সার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশের পৃথক তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, মহাসড়কের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অংশের (৩৮)আটত্রিশ কিঃমিঃ এলাকায় (২০২২ সালের ২২ অক্টোবর) থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে (১৯৮) একশত আটানব্বইটি। মৃত্যু হয়েছে প্রায় (৬২) বাষট্টি জনের, আহত হয়েছেন প্রায় (২৩৩) দুইশত তেত্রিশ জন।
তার আগের বছরে (২০২১ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ২১ অক্টোবর) প্রায় (২২৪) দুইশত চব্বিশটি দুর্ঘটনা ঘটলেও মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের, আহত হয় (২০৪) দুইশত চারজন। এক বছরের ব্যবধানে দুর্ঘটনা ২৬ টি কমেছে, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৪৬ জনের, এবং আহতের সংখ্যাও বেড়েছে ২৯ জন।
সীতাকুণ্ড হাইওয়ে পুলিশ জানান, এক বছর ধরে তাঁরা সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হলেই মামলা করেন। আগে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে মীমাংসা করে ফেলার কারণে মামলা হতো না। তাই তখন অনেক দুর্ঘটনা নথিভুক্ত হতোনা।
দুর্ঘটনার কারণ-
ফায়ার সার্ভিস এবং হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দ্রুতগতিতে গাড়ী চালানো, কার আগে কে যাবে (ওভারটেক) প্রবণতা, মহাসড়কের ইউটার্ন গুলোতে সতর্কতা (সিগনাল) লাইট না জ্বালিয়ে যানবাহন গুলো রাস্তা পরিবর্তন করা, পার্শ্বসড়ক থেকে হঠাৎ মহাসড়কে গাড়ি উঠে যাওয়া, উল্টো পথে গাড়ী চালানো, অবৈধ অটোরিকশা (সিএনজি) চলাচল, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ী চালানো, যত্রতত্র ভাবে যাত্রী উঠানামা করা, চালক গাড়ী চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলা, এবং সড়কের পাশে বৈধ অবৈধ কন্টেইনার ডিফো পোর্ট লজিস্টিক সেন্টার,বিদ্যুতের খুঁটি, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট ও ইট,বালি,সিমেন্টের ব্যবসা ও সেসব মালামাল জমিয়ে রাখার কারণে মানুষের চলাচলের পথ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে দুর্ঘটনা ঘটছে।
দুর্ঘটনার স্পট-
সীতাকুণ্ড হাইওয়ে পুলিশের মামলার নথি অনুযায়ী সীতাকুণ্ড অংশের দুর্ঘটনার ৯৫ শতাংশ হয়েছে ১৮টি স্পটে। দুর্ঘটনা স্পটের মধ্যে রয়েছে- বাঁশবাড়ীয়া, বাড়বকুণ্ড বাজার, চারালকান্দি ইউটার্ন, জিপিএইচ ইস্পাতগেট, জোড়আমতল বাজার, ছোটকুমিরা বাজার, রয়েলগেট, মাদামবিবিরহাট, ভাটিয়ারী ও ফৌজদারহাট-বন্দরসংযোগ সড়কের মুখ, বড়দারোগাহাট, টেরিয়াইল বাজার, ছোট দারোগারহাট বাজার, পন্থিছিলা, সীতাকুণ্ড উত্তর বাইপাস, উপজেলা হাসপাতাল গেট।
সীতাকুণ্ড বারআউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আমীরউদ্দিন বলেন, উপজেলার বাড়বকুণ্ডের শুকলালহাট থেকে সিটিগেট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার মহাসড়ক বারআউলিয়া হাইওয়ে থানার অধীনে। এই এলাকাতেই পার্শ্বসড়ক রয়েছে প্রায় ১৩৯টি। অনেক শিল্প কারাখানার ভারী যানবাহন এসব পার্শ্বসড়ক থেকে হঠাৎ করে প্রচণ্ড গতিতে মহাসড়কে উঠলে দুর্ঘটনা গুলো বেশি ঘটে।
তিনি আরো বলেন, মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক নেই। শুধু অসচেতনতার কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা গুলো ঘটছে। এক্ষেত্রে যাত্রী, মালিক, শ্রমিক, পথচারী সহ সবাই সচেতন না হলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয় বরং আরো বাড়বে।
সীতাকুণ্ড হাইওয়ে থানা পুলিশ জানায়, সড়কে ৭০ ভাগ গাড়ী চলাচল করছে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে। আবার হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্স করে ভারী যানবাহনও চালাচ্ছেন চালকেরা। ভারী যানবাহনের লাইসেন্স পেতে বিভিন্ন জটিলতার কথাও বলছেন । অনেকে আবার লার্নার লাইসেন্স নিয়ে মহাসড়কে যানবাহন চালাচ্ছেন। চালকদের অনিয়ম নিয়ে ব্যবস্থা নিতে গেলে যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের চাপে তা সম্ভবও হয় না বলে দাবি এ কর্মকর্তার।
সরেজমিনে দেখা যায়-
নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মহাসড়কে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নসিমন আবার একটির সঙ্গে অন্যটির ওভারটেকের প্রতিযোগিতাও দেখা যায় অনেক।
মহাসড়কে অবৈধভাবে তিনচাকার গাড়ী চলাচলের কারণ জানতে চাইলে হাইওয়েপুলিশের উপপরিদর্শক আমিরউদ্দিন জানায় ,যেসব অবৈধ যানবাহন মহাসড়কে চলছে,এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মামলা দেওয়া হচ্ছে, তবু এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। সিএনজিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে গেলে স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে পড়েন বলেও দাবি পুলিশের।
সিএনজি গাড়ী চালকদের অভিমত-
সিএনজি চালক (সাব্বির) ছদ্মনাম তিনি বলছেন পুলিশ চাইলে কখনো আমরা গাড়ী মহাসড়কে চালাতে পারবোনা। এখনও অনেক ড্রাইভার মহাসড়কে গাড়ী চালায় না। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গাড়ী চালায় তাঁরা যারা পুলিশের সাথে হাত রেখে প্রতিমাসে তাদের টাকা দিয়ে চালায়। আবার অনেকে ও-ই সাহস নিয়েও চালায় যে ধরা পড়লে পুলিশকে টাকা দিয়ে মানিয়ে নিবে! হচ্ছেও তাই। যারা পুলিশকে টাকা দেয়না তাঁরা এমারজেন্সি কোনো কারণে যদিও মহাসড়কে ওঠে তবে মানেমানে সারতে পারলেতো পারলো, তা নাহলে পুলিশের মামলা খায়, পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে দূর্ঘটনার সম্মুখীনও হয়। সাব্বির আরো বলেন সিএনজি ছাড়া মহাসড়কের পাশাপাশি মানুষের চলাচলও অনেক কঠিন, তাই যাত্রীদের বিপদেআপদে আমরাও বাধ্য হয়ে মহাসড়কে গাড়ী চালাতে হয়।
যেভাবে দুর্ঘটনার তথ্য দ্রুত পাওয়া যায়-
জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এর কারণে আগের চেয়ে অনেক দ্রুত দুর্ঘটনার তথ্য মিলছে বলে ফায়ার সার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশ বলছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ও হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের কাছে দুর্ঘটনার প্রায় ৭৫ শতাংশ খবরই আসে ৯৯৯-এর মাধ্যমে।
ফায়ার সার্ভিস কুমিরা স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণ মানুষ ফায়ারসার্ভিসের নাম্বার না জানলেও জরুরি সেবা নাম্বার ৯৯৯ সহজ হওয়াতে তাদের মূখস্ত। তাঁরা সেখানে ফোন করেন। তাই দ্রুত খবর পাওয়া যায় এবং আমরা দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারি। আহতদেরও আমরা দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হয়।
কেন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে-
কর্মকর্তারা জানান, মহাসড়েক দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কারণে। অতিদ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারলে ও আহতদের হাসপাতালে দ্রুত নেওয়া গেলে মৃত্যুর শঙ্কা কমানো যেতো।