
দেলোয়ার হোসেন
গত কাল( ২১ শে জুলাই রোজ শুক্রবার )রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৫ এর একটি আভিযানিক দল কক্সবাজারের টেকনাফ থানাধীন বাহারছড়া-শ্যামলাপুরের গহীন পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এর অন্যতম সামরিক কমান্ডার ১। হাফেজ নুর মোহাম্মদ (২৮), পিতাঃ দিল মোহাম্মদ’কে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাহারছড়া ও শ্যামলাপুরের বিভিন্ন এলাকা হতে আরসা’র অন্যান্য সন্ত্রাসী ২। মোহাম্মদ হোসেন জোহার (৩০), পিতাঃ ধলা মিয়া ও ৩। মোঃ ফারুক @হারেস (২৩), পিতাঃ ওবায়দুর রহমান, ৪। মনির আহাম্মদ (৩৬), পিতাঃ জমলুক, ৫। নূর ইসলাম (২৯), পিতাঃ অলি আহাম্মদ, ৬। মোঃ ইয়াছিন (২১), পিতাঃ হোসেন’দেরকে গ্রেফতার করা হয়। ০১টি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ০১টি বিদেশী রিভলবার, ০১টি শর্টগান, ০৪টি দেশীয় এলজি, ০৩টি দেশীয় রামদা ও গোলাবরুদসহ নগদ ৭০,০০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরসা’র সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে খুন ও অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃতরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক এবং পাশর্^বর্তী দেশের সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এর শীর্ষ নেতা ও সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মোহাম্মদ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প অন্যতম এর সামরিক কমান্ডার হিসেবে ‘আরসা’র নেতৃত্ব প্রদান করত। তার নেতৃত্বে ‘আরসা’র ৩০-৩৫ জন সদস্য কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প ও তার পাশর্^বর্তী এলাকাসমূহে খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য তারা পাশ^বর্তী দেশ হতে দূর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করতো বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মোহাম্মদ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে শরণার্থী শিবির ও স্থানীয় জনগণের নিকট হতে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করতো। চাঁদার অর্থ না পেলে ভিকটিমকে অপহরণপূর্বক শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনসহ মুক্তিপণ আদায় করত। মুক্তিপণ না পেলে তারা ভিকটিমকে খুন করে গহীন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করতো বলে জানা যায়। সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরণের মাদক বাংলাদেশে পরিবহণ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও সংলগ্ন এলাকাসমূহে সংরক্ষণের কাজে মাদক ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট চাঁদার বিনিময়ে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরা সহযোগিতা করতো বলে জানা যায়। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষে পাহাড়ী গহীন জঙ্গলে আত্মগোপনে চলে যেত। তাদের অত্যাচারে শরণার্থী শিবিরের শরণার্থীরা সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তারা তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করতো বা অপহরণের পর লাশ গুম করতো বলে জানা যায়। তারা বেশ কয়েকদিন ধরে আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানাধীন শ্যামলাপুরে অবস্থান করছিল বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত হাফেজ নুর মোহাম্মদ (২৯) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। ২০১৬ সালে সে ‘আরসা’ সদস্য আরিফ উদ্দিনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘আরসা’ এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে সে সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পায়। আরসার সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের সাথে তার বিশেষ সখ্যতা ও নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। সে কুংফুতে বø্যাক বেল্ট প্রাপ্ত ও বিস্ফোরক তৈরীতে পারদর্শী ছিল। সে আরসা’র অন্যান্য সদস্যদের কুংফু প্রশিক্ষণ দিত। সে আরসা’র সামরিক শাখার প্রধান ওস্তাদ খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ও আরসা’র মূল সংগঠক আরিফ উদ্দিন @ হাসেম @ কুইল্লা এর কাছ থেকে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নেয়। পরবর্তীতে সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-৮ এ অবস্থান করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে সে ক্যাম্প-৮ এ আরসার হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। তার নেতৃত্বেই কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এর আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করে। সে হেড মাঝি শফি উল্লাহ হত্যাকান্ড, সালাম হত্যাকান্ড, সলিম হত্যাকান্ড, মালেক হত্যাকান্ড, হাবুইয়া হত্যাকান্ড, ইমান হত্যাকান্ড, আবুল মুনসুর হত্যাকান্ড, সালেহ হত্যাকান্ড, জোরপূর্বক একজন মহিলার ঘরে প্রবেশের সময় মহিলা বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যাকান্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ০৬ জন হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত ছিল। সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা’র জন্য চাঁদা সংগ্রহ এবং আরসা’র শীর্ষ নেতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থ ক্যাম্পের জিম্মাদারদের মাঝে বণ্টন করত। এছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ¦তন কর্মকর্তা নিহত হন। উক্ত সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুত্বর আহত হন। উক্ত হত্যাকান্ডের সাথে সে সরাসরি জড়িত ছিল এবং ঘটনাস্থলে নিজে উপস্থিত থেকে উক্ত কর্মকর্তার মৃত্যু নিশ্চিত করে বলে জানা যায়। বিভিন্ন সময়ে অপহরণ/টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহীন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকতো বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫ এর অধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত মোঃ হোসেন @ জোহার (৩০) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিক। সে ২০১৬ সালে আরিফ উদ্দিন @ হাসেমের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসা’য় যোগ দেয়। আরসা’য় যোগদানের পর সে অস্ত্র চালনা, কুংফু ও রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ লাভ করে। সে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশপূর্বক শরণার্থী ক্যাম্প-১৫ এ অবস্থান করে। পরবর্তীতে ক্যাম্প-১৫ এ আরসা’র হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়। বিভিন্ন সময়ে হাফেজ নূর মোহাম্মদ ও মাস্টার সলিম এর নির্দেশনায় তার নেতৃত্বে টার্গেট কিলিং, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেলে হত্যাপূর্বক লাশ গুম করা হতো। এছাড়াও, সে শরণার্থী শিবিরে হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা, সাবমাঝি সৈয়দ হোছেনকে গুলি করে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা ও শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যার প্রধান সহযোগী হিসেবে জড়িত ছিল বলে জানা যায়।