
মোজাহের ইসমাইল নাঈম, নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধিঃ
চাটখিল উপজেলার নাহারখিল গ্রামের মৃত রহমত উল্যাহর ছেলে মো. জাহাঙ্গীর আলম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে গত এক দশক থেকে জেলাসহ সারা দেশ দাপিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত সফরে গাড়ি বহর ও প্রশাসনিক প্রোটোকল নিয়ে চলাচল করতেন রাজকীয় স্টাইলে।
বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রণালয় ও সোনাইমুড়ী-চাটখিল থানা নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজ হাতে। গত রবিবার জাহাঙ্গীর আলম, তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে। সেই সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক একাউন্ট খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব থাকলে সেসব হিসাবের লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২–এর ২৩ (১) (গ) ধারার আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হলো।
এর আগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জাহাঙ্গীর আলম সম্পর্কে সকলে সতর্ক করা হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং এর সেই সতর্ক বার্তায় বলা হয়েছিলো, “প্রধানমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের কোন সম্পর্ক নেই। তার ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতেও প্রধানমন্ত্রীর কর্যালয়ের পক্ষ থেকে সকলকে অনুরোধ করা হয়েছে।”
তথ্য বলছে, ৯০ দশকের দিকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি সুধাসদনে আসা দলীয় নেতা-কর্মীদের পানি খাওয়ানোর কাজ করতেন জাহাঙ্গীর। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে শেখ হাসিনার খাদ্য বহনকারী হিসেবে ‘টিফিন ক্যারিয়ার’ তিনি নিজ হাতে রাখতেন।
২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দুঃসাহসিক ভূমিকা রাখায় তিনি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মাঝে পরিচিতি লাভ করেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর গণভবনে যাতায়াতের সুযোগ পান জাহাঙ্গীর। ঢাকার ইপিজেডে ২০০৯ সালে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
দলীয় নেতা-কর্মীরা ঝুট ব্যবসায় হাত দিলে জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পরিচয়ে ফোন করে সরাসরি তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন। এই ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করেছেন তিনি। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি এবং মন্ত্রীদের কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পরিচয় দিয়ে তদবির করতেন।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজ এলাকা নোয়াখালী-১ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি জাহাঙ্গীর। পরে নোয়াখালী-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এইচএম ইব্রাহীম বিপক্ষে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রচারণা চালান। শেষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন।
অভিযোগ রয়েছে, চাটখিলে মো. জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিতেন। এ পরিচয় দিয়ে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কমিটির সহ সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। এ ছাড়া এলাকায় চাকরি-বাণিজ্য, কমিশন-বাণিজ্য, প্রাইভেট বিদ্যালয় দখল, জমি দখল, ইটভাটা দখল, টেন্ডারসহ সন্ত্রাস চলতো তার নামে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হুমকি দিয়ে অনিয়ম করে বেশ কয়েকজনকে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করান। জাহাঙ্গীর আলম তার ভাগনে শিপনের মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর গল্প বলে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। ওই পরিচয় দিয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করতেন।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রবিবার সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি নিজের বাসার সাবেক এক কর্মীর অর্থসম্পদের বিষয়টি সামনে আনেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানাল এত টাকা? জানতে পেরেছি, পরেই ব্যবস্থা নিয়েছি।’
জানা যায়, জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে টানা দুই মেয়াদের পাশাপাশি গত মেয়াদেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় তাঁকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তারপরও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করেছেন তিনি।