চট্টগ্রাম ব্যুরো– বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলার উদ্যাগে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতাওয়াদ্দেদার এর ৯১তম আত্মাহুতি দিবস স্মরণে চট্টগ্রাম সরকারী মহিলা কলেজ অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম জেলার আহ্বায়ক আসমা আক্তারের সভাপতিত্বে কলেজ শিক্ষার্থী কেয়া আক্তারের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন– সহকারী অধ্যাপক নিগার সুলতানা, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রিয় সভাপতি,সীমা দত্ত, মাদারতেরেসা হোস্টেল তত্তাবধায়ক কাবেরী বড়ুয়া,শিক্ষার্থী ইমা আক্তার প্রমূখ।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর পথিকৃৎ পুষ্পস্তবক অর্পণ করার মধ্যামে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মাকে লেখাচিঠি পাঠ করে জাফরিন ফেরদৌসি।
আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, “মাতৃভূমির জন্য আত্মত্যাগের কাহিনী বিরল নয়। যুগে যুগে ক্ষণজন্মা বীরেরা শত্রুর হাত থেকেনিজের রক্তের বিনিময়ে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করেছে বারবার, জীবনের মায়া ভুলে দেশের মানুষের কথা ভেবেছে হাজার হাজারতরুণ–তরুণী। এ মিছিলে নারী–পুরুষের অংশীদারিত্ব ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু প্রীতিলতা যেসময় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদেন সেসময় এদেশে নারীদের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত ছিল না। প্রীতিলতা এই স্বপ্ন নিয়েই আত্মাহুতিদিয়েছিলেন যে, তাঁর আত্মদানের মধ্য দিয়ে দেশের বোনেরা স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের ভাইয়েদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়েলড়াইয়ে যোগ দেবে।
১৯১১ সালের ৫ই মে, বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলাঘাট গ্রামে প্রীতিলতার জন্ম। প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানছিল ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় প্রীতিলতা ছিলেন শিক্ষকদের প্রিয়। বিশেষ করে তারইতিহাসের শিক্ষিকা উষাদির সাথে তার ছিল খুব ভাল সম্পর্ক। এই উষাদিই একদিন প্রীতিলতাকে ‘ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই‘ নামেরএকটি বই পড়তে দেন। বইটি প্রীতিলতা ও তার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু কল্পনা দত্তের মনোজগতকে দারুণভাবে আলোড়িত করে, ছোটবেলা থেকে লালিত বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নের স্থানে জায়গা করে নেয় বিপ্লবী হওয়ার স্বপ্ন।
এরকম সময়ে একদিন প্রীতিলতাদের বাড়িতে আসেন তার এক দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী দলের একজন কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃকবাজেয়াপ্ত কিছু বই প্রীতিলতার কাছে গোপনে রেখে গেলে কৌতূহলবশত প্রীতিলতা বইগুলো খুলে দেখে এবং একে একে পড়ে ফেলে ‘বাঘাযতীন‘, দেশের কথা‘, ‘ক্ষুদিরাম‘ আর ‘কানাইলাল । সেই বয়সেই বইগুলো প্রীতিলতার চিন্তাজগতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। তখন তিনিসবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। তখন থেকেই তিনি দেশের কাজে অংশগ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করেন। কিছুদিন পর তার সেই বিপ্লবী দাদাপূর্ণেন্দু দস্তিদার তাদের বাড়ি এলে প্রীতিলতা জানান তার ইচ্ছার কথা। জানান যে তিনিও বিপ্লবী হতে চান। কিন্তু তখন পর্যন্ত দলেকোনো নারী সদস্য নেওয়া হতো না। তাই তাঁর দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার দ্বিধান্বিত ছিলেন। প্রীতির প্রশ্নের জবাবে তিনি নিরুত্তর থাকেন।প্রীতিলতা ভাবতে থাকেন, “দেশ তো আমারও, তাহলে আমি কেন দেশের জন্য কাজ করতে পারব না?”
অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোগী হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হতে সক্ষম হনতিনি। মাস্টারদার দলে যোগ দিয়ে আশৈশব লালিত স্বপ্ন, পরাধীনতার লাঞ্ছনা থেকে দেশমাতৃকা ও দেশের মানুষের মুক্তিযজ্ঞে নিজেকেনিবেদিত করেন। তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেন। মাস্টারদা‘র দলের নেতৃত্বে তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে বহু অভিযান হতো। সেইসবঅভিযানে প্রীতিলতাও অংশগ্রহণের আকুতি পোষণ করেন। অবশেষে মাস্টারদা প্রীতিলতাকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবআক্রমণের দায়িত্ব দেন। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে অপারেশন। প্রীতিলতার মনে তখন উত্তেজনার ঝড়। পূর্বে বহুবার তিনিচেয়েছেন, এরকম কোনো অভিযানে যোগ দিতে। এতদিনে তার সে সুযোগ এসেছে। কিন্তু সশস্ত্র অভিযানের কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই।তবে আছে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, দেশের জন্য আত্মত্যাগের কঠিন সংকল্প। প্রীতিলতা মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন, দেশের মানুষেরউদ্দেশ্যে লিখেন তাঁর এই মরণখেলায় অংশ নেওয়া কথা।“
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ” ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে দেশের স্বাধীনতার জন্য নারীরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করুক–এটাইচেয়েছিলেন প্রীতিলতা। আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে তিনি সেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েরা যে এখনও পিছিয়ে আছেতার কারণ তাদের পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে। নারীরা এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যতই কঠিন ওবিপদসঙ্কুল হোক না কেন ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমারবোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববেন না এবং ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামে হাজারে হাজারে যোগদান করে সমস্ত রকম বাধা এবং বিঘ্নেরসম্মুখীন হবেন ।‘
নেতৃবৃন্দ বলেন, “প্রীতিলতার মতো অসংখ্য শহীদের আত্মদানে পরাধীন ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এই শহীদদের স্বপ্নের সমাজপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? নারীদের মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? আজ ব্রিটিশ নেই, পাকিস্তানী শাসক নেই। তারপরিবর্তে আছে দেশীয় শোষক শ্রেণী। এদের সবার চরিত্রই এক। সব শাসকরাই মানুষের বিবেককে মেরে দিয়ে, অন্ধ বিশ্বাস আর ধর্মীয়গোঁড়ামীকে উসকে দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছে। বর্তমান সময়ের শাসকরাও তেমনই চায়। তারা হতাশা, হানাহানি, অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব, মাদকের বিস্তার, যৌন সুড়সুড়ি তৈরী করে যুবক তরুণদের বিপথগামী করে নিজেদের সকল অন্যায়, জবরদস্তিমূলক সমাজ ওরাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। তাই ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, মাষ্টারদা, প্রীতিলতার জীবন সংগ্রাম তাদের কাছে আতঙ্কের বিষয়।এঁদের স্মৃতিকে দেশের মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে, ভুলিয়ে দিতে শাসকদের চেষ্টার অন্ত নেই।
অন্যদিকে দেশের একদল সচেতন ও সাহসী মানুষ মহান এই পূর্বসুরীদের জীবনসংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের দিনের এইবিপদসঙ্কুল পথে এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায়। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার শক্তি পায়। তাই নবজাগরণের সংগ্রামে যাদের কীর্তিঅতুলনীয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই পরিচালনা করেছিলেন, তাঁদের জীবনকে তরুণসমাজেরসামনে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাহস অর্জন করতে প্রীতিলতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদেরগড়ে তুলতে এই মহৎ চরিত্রের চর্চা করতে হবে।“