
মোঃ রফিকুল ইসলাম
ক্রাইম রিপোর্টার
দালালের খপ্পরে লিবিয়া থেকে লাশ হয়ে বাংলাদেশে ফিরল এক যুবক। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় মানুষের বিদেশের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।নিজের এবং পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ‘অশুভ’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখাচ্ছেন দেশের তরুণ-যুবক। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকে নিজের জীবন পর্যন্ত হারাচ্ছেন। এর মাধ্যমে ঐসব যুবকের পরিবারও হয়ে যাচ্ছে নিঃস্ব।
ইতালি নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও দালালরা ভুক্তভোগী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে দেয় মাফিয়াদের হাতে। তাদের খপ্পরে পড়ে শুধু অর্থ নয়, প্রাণও দিতে হচ্ছে অনেক যুবককে।দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। বৈধ-অবৈধ নানা পথে তারা পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। উন্নত জীবনের আশায় বিদেশমুখী প্রবণতার কারণে দালালচক্রের পাতা ফাঁদে পড়ে অনেকেই হারাচ্ছেন সর্বস্ব কারও কারও সলিল সমাধি হচ্ছে প্রবাসের মাটিতেই।
তবে দালালরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় লিবিয়া থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা ফয়েজ আহম্মেদ(২২) বছর বয়সি যুবক । ২০২১ সালে তেমুহনী আব্দুল রশিদ ভূইয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তবে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ২৮ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে তার লাশ দেশে পৌঁছায়। অভিযোগ রয়েছে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মোমেনুল হক মুন্না ও ইসমাইল হোসেনের দাবিকৃত টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় খুন করা হয়েছে ফয়েজকে। পরে নিহতের পরিবারকে নানা শর্ত মানতে বাধ্য করে লাশ দেশে পাঠানো হয়। তবে এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। জানা যায়, লিবিয়ায় খুন হওয়া যুবক বসন্তপুর গ্রামের প্রবাসী মইন উদ্দিনের ছেলে।
অপরদিকে অভিযুক্ত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মোমেনুল হক মুন্না ও ইসমাইল হোসেন সম্পর্কে মামা-ভাগিনা। মোমেনুল হক মুন্না ছাতার পাইয়া ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের মৃত আবুল বাসারের ছেলে। আর ইসমাইল হোসেন পার্শ্ববর্তী কাবিলপুর দক্ষিণপাড়া আলাউদ্দিন মাওলানা বাড়ির বাসিন্দা।
মানব পাচার সিন্ডিকেট গড়ে নোয়াখালী ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতালিতে চাকরি দেওয়ার নামে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে আটকে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। অনুসন্ধানের জানা যায় প্রায় ৫০ বছর থেকে ইসমাইল হোসেন প্রবাসে রয়েছেন। দীর্ঘ প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন গ্রিসে। ২৫ বছর থেকে তিনি লিবিয়া ইতালি-গ্রিস রুটের মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। লিবিয়ার প্রবাসী বাঙালিদের কাছে তিনি এই রুটের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। গেইমের নামে লিবিয়ান পুলিশের কাছে আটক করিয়ে পরে মুক্ত করার অজুহাতে অর্থ আদায় করে। দেশ থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে আটকে মুক্তিপণ আদায় করেন এই মাফিয়া। আর তার সহযোগী হিসেবে ৮ বছর থেকে কাজ করেন ভাগিনা মোমেনুল হক মুন্না। ইসমাইল হোসেনের এক ছেলে আরাফাত হোসেন শিপলু আমেরিকান প্রবাসী। আরেক ছেলে ইশতিয়াক হোসেন সিহাব আইএলটিএস করে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় আছেন।
মানব পাচার চক্রের টাকায় কুমিল্লার ভোগই মনোহরগঞ্জ শ্বশুরবাড়ির এলাকায় দিয়েছেন আলিশান বাড়ি। দেশে তার সব সম্পদের দেখাশোনা করেন শ্বশুর আব্দুর রহমান ভূইয়া। বিভিন্ন সময় মুক্তিপণ আদায়ের পর হত্যা ও গুমের অভিযোগ থাকলেও ভুক্তভোগীরা অবৈধ অভিবাসী হওয়ায় আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন মাফিয়া ইসমাইল। আরেক ভুক্তভোগী সোনাইমুড়ী উপজেলার ছনগাঁও গ্রামের মৃত মোবারক উল্লাহর ছেলে সোহাগ জানান, ইতালিতে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই চক্রের সদস্য একই গ্রামের রাব্বি তার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ইতালির কথা বলে সালা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে প্রথমে দুবাই, পরে লিবিয়ার রাজধানী বেনগাজিতে নিয়ে একটি রুমে আটক করে রাখে। সেখানে মাফিয়া চক্রের প্রধান হোতা ইসমাইল হোসেনের কাছে তুলে দেয়। দীর্ঘ ৫ মাস অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে। সেই নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজ দেশে পাঠিয়ে পরিবারের কাছে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
ঋণ করে দাবিকৃত টাকা পাঠালে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ওই উপজেলার মাছিমপুর গ্রামের লিবিয়া ফেরত অনিক তার ওপরে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কাহিনি বর্ণনা করেন প্রতিবেদকের কাছে। তিনি তুলে ধরেন কীভাবে মাফিয়া চক্রের নেতা ইসমাইল ও মুন্না বাংলাদেশি প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করতেন। ৫ মাস আগে তাকে ইতালি পাঠানের কথা বলে লিবিয়া নেয় চক্রের হোতা ইসমাইল। সেখানে সাগরপাড়ে একটি কক্ষে গেইম দেওয়ার কথা বলে দীর্ঘ আড়াই মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। তিনবেলা খাবার দিত না। শুকনো রুটি খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে ছিলেন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে অন্যের সহযোগিতায় বাংলাদেশে ফেরেন। ওই রুমে, চাঁদপুর, কুমিল্লা, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার প্রায় দুই শতাধিক আটক ছিল। তাদের জিম্মি করে মারধর করতো প্রতিরাতে।
এসব দালাল চক্রের সঙ্গে লিবিয়ার পুলিশ ও বাংলাদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরা যুক্ত রয়েছেন। পাচার চক্রের মাফিয়াদের থেকে দূতাবাসের কতিপয় লোকজন মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নিরীহ বাংলাদেশিদের হয়রানি করে। কোনো বাংলাদেশিকে লিবিয়ার পুলিশ আটক করলে দূতাবাস থেকে সহায়তা করতে ঘুষ দাবি করা হয়। মাফিয়া ইসমাইলের বিষয়ে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছেন তার আপন ভাতিজা আলমগীর পাপ্পু। তিনিও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইসমাইলের মাধ্যমে লিবিয়ায় যান। তাকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গেইম দেওয়া হয়। গেইমের নামে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয় ও গেইম ঘরে ১ মাস আটকে রাখা হয়। গেইম দিয়ে ৪ দিন সাগরে থাকার পর লিবিয়ার কোষ্টগার্ডের হাতে গ্রেপ্তার হয়। জেলখানায় ৪ দিন থাকার পর তাকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। ইতালি পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে নৌ যোগে গ্রিসে পাঠিয়ে সব যোগাযোগ বন্ধ করেছেন ইসমাইল। বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করছেন আলমগীর পাপ্পু।
লিবিয়ায় থাকাকালীন অমানুষিক পরিশ্রম করালেও তার পারিশ্রমিক দেয়নি ইসমাইল। এ ঘটনা ফেসবুকে দেওয়ায় হুমকির শিকার হয়েছেন পাপ্পুর পরিবার। এ বিষয়ে পাস্তুর ভাই আহাদ জানান, ইসমাইল হোসেন তার আপন চাচা। তিনি অনেক দিন থেকে আদম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। যারা ঝামেলায় পড়েন তারা অভিযোগ তোলেন। তার ভাই পাস্তুর লিবিয়ায় অনেক কষ্টে দিন পার করেছেন। চাচা হিসেবেও ছাড় দেননি ইসমাইল হোসেন। আর এই ঘটনা ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়ায় তার বাড়িতে এসে হুমকি দিয়েছে কতিপয় ব্যক্তি। তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
মাফিয়া ইসমাইলের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্যে লিবিয়া গিয়ে গত ১১ মাস থেকে নিখোঁজ রয়েছেন সোনাইমুড়ী উপজেলার যুগি পূর্বপাড়ার মো. জাফর। তার চাচা সিরাজ মাস্টার বলেন, ‘ইতালির উদ্দেশ্যে দালাল ধরে আড়াই বছর আগে লিবিয়া গিয়েছিলেন বাড়ির বড় ছেলে ফারুক। এখন শুনেছি তাকেসহ মাইজদি এলাকার বাসিন্দা আরেক ব্যক্তিকে মেরে মরুভূমিতে ফেলে দিয়েছে দালালরা।’
মানব পাচার চক্রের মাফিয়া ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, যাদের আপনারা ভুক্তভোগী বলছেন তারা নিজেরাই আমাদের কাছে আসে। আমরা তাদের লিবিয়ায় ডেকে আনিনি। যারা অবৈধভাবে আসেন তারাও জানেন এই পথে ঝুঁকি আছে। জিম্মি করে টাকা আদায় ও হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিহত ফয়েজ আহম্মেদ কীভাবে মারা গেছেন তা তিনি জানেন না। তবে লাশ তিনি যে দেশে পাঠিয়েছেন সেই বিষয়টি স্বীকার করেন। এ বিষয়ে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের হাই-কমিশনার মেজর জেনারেল খায়রুল বাসারের বক্তব্য নিতে কল দেওয়া হয়। দূতাবাসের এক কর্মচারী ফোন রিসিভ করে পরে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হবে বলে ফোন রেখে দেন।