
মো: ওমর ফারুক খান জুবায়ের, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি।
২০২১ সালে আমেরিকাকে হটিয়ে তালেবান যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল তখন তাঁরা পশ্চিমা বিরোধী বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে অপ্রকাশ্য সমর্থন ও ভালোবাসা অর্জন করেছিল | যুদ্ধ জয়ের মত রাষ্ট্র পরিচালনাতেও তাঁরা সাফল্য অর্জন করুক সেই চাওয়াটা ছিল অনেকেরই অন্তরের সুপ্ত বাসনা |
তবে ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে একটি ভয়ংকর পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তালেবান সাফল্য পেলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সাফল্য নিয়ে ব্যাপক সন্দিহান ছিলেন বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই |
দুই দশকের সংগ্রামী জীবনে তালেবান অনেকটাই বদলেছে এমন আশা ছিল আমারও | কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি | নিজেদের মূর্খতা ও অযোগ্যতার প্রমান দিতে খুব বেশি সময় নেয়নি তালেবান দলটি |
অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। তালেবানের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর একটি চিঠিতে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আফগান নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা বন্ধ থাকবে।
পদক্ষেপটির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় আফগান নারীদের প্রবেশাধিকারকে আরও সীমিত করল তালেবান। দেশটিতে ইতিমধ্যে বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বাদ পড়েছে।
তালেবানের এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির নারী সমাজ ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে | এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বিবিসিকে বলেন, তিনি মনে করেন, তালেবান নারী ও নারীর শক্তিকে ভয় পায়।
ক্ষুব্ধ ঐ ছাত্রী আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করতাম যে পড়াশোনা করে আমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারব, আমার জীবনে আলো আনতে পারব। কিন্তু তারা (তালেবান) তা ধ্বংস করে দিয়েছে।’
বর্তমান প্রেক্ষাপটে তালেবানের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক বা গ্রহনযোগ্য তা ভেবে দেখার বিষয় | ইসলামী শরীয়ত প্রতিষ্ঠার অজুহাতে তাদের এমন সিদ্ধান্ত আসলে কতটা শরীয়ত সম্মত তা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা দরকার |
জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প ইসলামে নেই। ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞানচর্চার যে প্রবাহ শুরু হয়, নারীরাও সেখানে শামিল ছিল। পরবর্তীতে আববাসীয় ও উমাইয়্যা যুগে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য না করে উভয়কে সমভাবে জ্ঞানার্জনের আদেশ দিয়েছে। কুরআনের নির্দেশও তাই। কুরআন সকল পাঠককেই আদেশ করছে পড়তে, চিন্তা-গবেষণা করতে, অনুধাবন করতে, এমনকি বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে লুক্কায়িত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে।
নবী (সা) এর কাছে প্রথম যে ওহী নাযিল হয়েছিল তার প্রথম শব্দ ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পাঠ কর। এখানে স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই পাঠ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং জ্ঞানার্জন শুধুমাত্র পুরুষের জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়নি, পুরুষের মত নারীকেও জ্ঞানার্জনের পূর্ণ অধিকার বা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এমনকি নবী (সা) ক্রীতদাসীদেরকেও শিক্ষার সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দান করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তার বক্তৃতার আসরে যোগ দিতেন। বদর যুদ্ধে বন্দীদের শর্ত দেয়া হয়েছিল যে, তাদের মধ্যে যে কেউ দশজন মুসলিমকে বিদ্যা শিক্ষা দিবে তাকে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেয়া হবে।
শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে ইসলাম কতটা উদার ও উৎসাহী তা ইসলামের ইতিহাস সামান্য পড়লেই জানা যায় | তালেবান সরকারের সিদ্ধান্তগুলো দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা ইসলামের এই অধ্যায় পড়া তো দূরের কথা ছুঁয়েও দেখেনি অথচ তাদেরকেই এক শ্রেণীর মানুষ খাঁটি মুসলমান হিসেবে মনে করছেন | লেবাসের দিক থেকে তাঁরা খাঁটি মুসলমান বটে | কিন্তু এদের কারণে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ফোবিয়া পুনরায় বাড়ছে | আমার তো মনে হয় ভবিষ্যতে ইসলামের যে ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে তাতে তালেবান শাসনামল একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে | তালেবানদের বীরত্বগাথা যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসগুলো তাদেরই মূর্খতার কালো দাগে ঢাকা পরে যাবে |
তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর বুদ্ধি-বৃত্তিক আচরণের মাধ্যমে আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীদের জন্য পৃথক শ্রেণিকক্ষ বা নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে পারতো । গঠনমূলক সংস্কারের মাধ্যমে পুরো শিক্ষা ব্যাবস্থায় ইসলামী শরীয়তকে খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতো |
ক্ষমতার মসনদ দেখতে অনেক নরম ও আরামদায়ক কিন্তু বাস্তবে অনেক বেশি কণ্টকাকীর্ণ | ক্ষমতায় বসে এক বছরেরও বেশি সময় পার করলেও আজ পর্যন্ত একটি দেশেরও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি তাঁরা | নারী শিক্ষার এই ইস্যুটি তাদের স্বীকৃতিকে আরো কঠিন ও জটিল করে তুলবে |
এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় কাতর পুরো আফগানিস্তান | দেশটির অর্থনীতিতে বেকারত্ব বেড়েছে, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ঘটেছে, খাদ্যের অভাবে বাবা-মা তাদের সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে | আর এইসব হচ্ছে তালেবান সরকারের ধর্মীয় গোড়ামি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারনে |
যেহেতু তাদের কোন স্বীকৃতি নেই, এই অবস্থায় তালেবান সরকারের উচিত, ধর্মীয় গোড়ামি ত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত ভালো সম্পর্ক যে সকল দেশের সাথে আছে তাদের মধ্যে বিশ্বস্ত কোন দেশের সাথে কৌশলগত চুক্তির মাধ্যমে নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে তার সঠিক ব্যবহার করা | এছাড়া দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোন পথ খোলা নেই |
যেভাবেই হোক আফগান জনগণের দায়িত্ব তালেবান নিয়েছে এবং স্বেচ্ছায় নিয়েছে | এখন খুব বেশি তাড়াহুড়া করে তাদের পছন্দের সিদ্ধান্তগুলো জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইলে হিতে বিপরীত হতে পারে | তাদের উচিত সুশাসন ও স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া |
দেশের মানুষকে ভালো রাখতে হবে | দেশের মানুষ যদি ভালো না থাকে, দেশ যদি না বাঁচে তাহলে তালেবান, তালেবানের আইন-কানুন কোনো কিছুই বাঁচবে না |