ইফতেখার হোসেন- চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বহুল কাঙ্ক্ষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২৮ অক্টোবর) বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন তিনি। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। টানেল উদ্বোধনের পর আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ উদযাপন করা হয়। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) আগামী পাঁচ বছর টানেলের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করবে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাদের কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। টানেলের ভেতরে যেকোনো সমস্যায় দ্রুত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় সেই টিম ছুটে যাবে। তাদের সঙ্গে নৌবাহিনী, পুলিশ নিরাপত্তার কাজ করবে। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশ কাজ করবে যানবাহন চলাচল নিয়ে। অগ্নি দুর্ঘটনা ঠেকাতে টানেলের দুই প্রান্তে স্থাপন করা হচ্ছে প্রথম শ্রেণির দুটি ফায়ার স্টেশন। কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই) স্থাপনা বিবেচনায় নিরাপত্তায় থাকবে টানেল। প্রবেশমুখে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হচ্ছে চারটি অত্যাধুনিক স্ক্যানার। বর্তমানে দুই প্রান্তে দুটি স্ক্যানার বসানোর হয়েছে। স্ক্যানার দিয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলোতে চালক ও পণ্য রাখার অংশ আলাদা রঙের রশ্মি দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এছাড়া টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী বাস, কার, মাইক্রোবাস অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রে স্ক্যানারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)। ইউভিএসএস দিয়ে যানবাহনের নিচের অংশে বিস্ফোরকজাতীয় সরঞ্জাম আছে কি না, তা যাচাই করা হবে। সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ব্রিটেন থেকে আনা স্ক্যানারগুলো টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। ১৩ টন ওজনের প্রতিটি স্ক্যানার প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ও প্রশস্ত ১০ মিটার। উদ্বোধনের সময় উপস্থিত অতিথিরা করতালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। টানেল উদ্বোধনের দৃশ্য জনসভাস্থলে বসানো বিভিন্ন ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শন করা হয়। মাইকে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক গানের সুর। সকালে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যান। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়িবহর টানেল এলাকায় প্রবেশ করে। টানেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারা টোল প্লাজায় যান। সেখানে টোল প্লাজা কমপ্লেক্স ও টানেলের স্মার্ট মনিটরিং কক্ষ পরিদর্শন করেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী পৌনে ১২টায় পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে টোল প্লাজায় টোল দিয়ে টানেল হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে যাত্রা করেন। এরপর সেখানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে টোল নেন ঝুমুর আক্তার। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করেন। প্রথম যাত্রী হিসেবে টানেলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। এরপর তাঁর গাড়িবহরে থাকা অন্য গাড়িগুলো টোল পরিশোধ করে। ঝুমুর আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, টানেলে প্রথম যাত্রী প্রধানমন্ত্রী টোল দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে টোল নিতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে নিয়ে যখন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তখনো এতদঞ্চলের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেনি। ভাবেনি, মাত্র কয়েক মিনিটে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে আনোয়ারা যাওয়া সম্ভব হবে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রথম টানেল টিউব নির্মাণকাজ উদ্বোধন করার পর সেই স্বপ্ন ডানা মেলতে থাকে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া আরও ১৯টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন তিনি। বর্তমান সরকার বন্দরনগরকে চীনের সাংহাই নগরের মতো ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে পরিণত করতে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করছে এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমিয়ে দিচ্ছে ৪০ কিলোমিটার। এই টানেল দিয়ে যানবাহন চলবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে। নগরের পতেঙ্গা নেভাল অ্যাকাডেমির পাশ ঘেঁষে শুরু হয়ে কর্ণফুলী নদীর মাঝ দিয়ে দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে উঠেছে এ টানেল। আনোয়ারার চাতরি বাজার থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে আনোয়ারা থেকে মাত্র ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর যাওয়া সম্ভব হবে। আনোয়ারা হয়ে বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে সহজ হবে যাতায়াত। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভেতর হয়ে পিএবি সড়ক ঘুরে যানবাহন উঠবে কক্সবাজার মহাসড়কে। এই টানেল ঘিরে শিল্প জোন আনোয়ারা পরিণত হচ্ছে উপশহরে। এখানে রয়েছে পারকি সমুদ্র সৈকত, সার কারখানা- সিইউএফএল, কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি এবং কোরিয়ান ইপিজেড ও চায়না ইকোনমিক জোন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে আনোয়ারাকে ‘গ্রোথ সেন্টার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই উপজেলায় শুরু হয়েছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদের চিত্র। টানেল সড়ক ধরে কক্সবাজার পর্যন্ত হয়েছে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ও রেলসংযোগ। সড়কের দুইপাশে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা এবং আবাসন। ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে জি টু জি পদ্ধতিতে গহিরা এলাকায় ৭৭৪ একর জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। সেখানে স্থাপন করা হবে ৩৭১টি শিল্প কারখানা। পারকি সৈকতের পাশে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এটি নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে। পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিট। টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। নগরের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক রয়েছে। টানেলের ভেতরে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি হবে ৮০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসিএল) লিমিটেড। তারা রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের কাজও করবে। চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও ১৯টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। উদ্বোধনের তালিকায় আছে- চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, জেলা পরিষদ টাওয়ার, রাঙ্গুনিয়া ও আনোয়ারা জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, শেখ কামাল অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল, রাউজানে শেখ কামাল কমপ্লেক্স, আগ্রাবাদে সিজিএস কলোনিতে নয়টি বহুতল আবাসিক ভবন, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও শিকলবাহা খালের ওপর পিসি গার্ডার ব্রিজ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন তালিকায় আছে- চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর, বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সড়ক ও সিমেন্স হোস্টেল কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ। এছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের বাস্তবায়ন করা বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে রয়েছে- ডিসি পার্ক, হাজার বছরের নৌকা জাদুঘর, ১৯১টি ইউনিয়নে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, স্মার্ট স্কুল বাস সার্ভিস, পর্যটক বাস, রিভার ক্রুজ ও ফুল ডে ট্যুর সম্বলিত পর্যটন সেবা, বার্ডস পার্ক ও চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরণ। ২০০৮ সালে লালদীঘির মাঠে নির্বাচনী সমাবেশে চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ হাতে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার প্রমাণ রেখেছেন নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর। তাঁর উদ্যোগে কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং, সদরঘাটে নতুন লাইটার জেটি নির্মাণ হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে নির্মিত হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। ২০১৭ সালে জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়। পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আউটার রিং রোড বাস্তবায়নের পাশাপাশি বায়েজিদ বাইপাস সড়ক চালু হয়েছে। লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরের ভেতর দিয়ে যান চলাচলে সহায়তা করবে। ৩০ হাজার একর জমিতে ২০১৮ সালে মীরসরাইয়ে শুরু হয় ৩৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। এই শিল্পনগর হবে আগামীর অর্থনীতির মূল ভিত্তি। রোববার ২৯ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য টানেলটি খুলে দেওয়া হবে। টানেলের নিরাপত্তায় লাগানো হয়েছে অত্যাধুনিক ১১০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। আনোয়ারা প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে মনিটরিং সেন্টার। যেখান থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে পুরো টানেলে নজরদারি চালানো হবে। টানেলের প্রতিটি টিউবে রয়েছে লম্বা একটি হিট সেন্সর। যেখানে অগ্নিকাণ্ড বা কোনো কারণে তাপ লাগা মাত্র অটোমেটিক সিসিটিভি ক্যামেরা ঘটনাস্থলের দিকে ঘুরে যাবে। এছাড়া কোনো দুর্ঘটনা হলে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি চালানো হবে।
ADVERTISEMENT