প্রচলিত আর্থসমাজিক ব্যবস্থার মৌলিক অর্থনীতিতে শেখানো হয় যে, দ্রব্যের যোগান বাড়লে দাম কমে আর যোগান কমলে দাম বাড়ে। আবার চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে, চাহিদা কমলে দাম কমে। কিন্তু অর্থনীতির এই মৌলিক সূত্র বর্তমান সমাজে অবাস্তব ও অকার্যকর নীতিতে পরিনত হয়েছে কারণ এখন বাজারে পণ্যের যোগান বাড়লে বা সমাজে কোন সেবা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বাড়লে পণ্যের বা সেবার দাম কমে না। প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থায় দ্রব্য-পণ্যের যোগান বাড়লে দাম কমবে কিন্তু বর্তমান সমাজের বাজারে দেখা যায় এর উল্টো চিত্র। বাজারে প্রচুর পণ্যের যোগান আছে কিন্তু পণ্যের দাম বৃদ্ধি। আবার যখন পণ্যের যোগান কম তখন পণ্যের দাম আরও বৃদ্ধি, বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয় পণ্যের আমদানি বা সাপ্লাই কম চাহিদা বেশি তাই দাম বৃদ্ধি। কোন পণ্য উৎপাদনের ভরা মৌসুমে দাম বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। যেকোনো পণ্য বাজারে আসার পর সেই পণ্যের কোন মালিক সরাসরি বিক্রি করতে পারেনা কারণ প্রত্যেকটি বাজার নগর থেকে শহর, বন্দর , গ্রাম, গঞ্জ সকল জায়গায় আড়ৎ বা মহাজনি সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেকোনো পণ্য বাজারে আসার বা ঢোকার আগে আড়তে যাবে তারপর সেই আড়তের গৃহপালিত খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা ঐ পণ্য এক ধরণের বণ্টন পদ্ধতিতে নিয়ে বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে বসবে। পণ্যের পাইকারি ও খুচরা মূল্য এই আড়ৎ থেকেই নির্ধারন করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনকারী বা উৎপাদনকারির নিকট থেকে সংগ্রহকারি প্রথম ব্যক্তির সাথে ক্রেতার কোন দেখা বা দর কষাকষির কোন সুযোগ নাই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই আড়ৎ মালিক বা মহাজনের এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার তেমন কোন পুঁজি খাটাতে হয়না।পণ্য উৎপাদনকারির নিকট একটা রেট বা দর নির্ধারন করে দেন আড়ত মালিকগন। আড়ত মালিকগণ খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের আরেকটা বর্ধিত মূল্য নির্ধারণ করে দেন। তারা পণ্য বিক্রি শেষে নির্ধারিত দামে মূল্য পরিশোধ করেন তারপর আড়তমালিকেরা পণ্যের মূল মালিককে আড়তের একটা অংশ কেটে রেখে মূল্য পরিশোধ করেন। এই পুরা প্রক্রিয়ার মধ্যে আড়ত মালিক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা কাউকে পুঁজি খাটাতে হলোনা, মাঝখানে থেকে যার যা করার সে তা করে নিল ইতিমধ্যে একটা পণ্য তিন চার হাত বদল হয়ে যতক্ষনে ভোক্তার নিকট পৌছালো ততক্ষণে দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি হয়েছে। ভোগ্যপণ্য ছাড়াও সেবা খাতেও একই অবস্থা। যেমন-যেকোন রুটে যানবাহন আগের চেয়ে অনেক বেশি। যোগান বাড়লে যদি দাম কমে তাহলে উদাহরণ স্বরূপ একটা রুটে যখন ১০টা বাস/সিএনজি /ইজিবাইক চলত তখন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ভাড়া ছিল ৫০টাকা।যখনঐ রুটে ২০টা বা/সিএনজি /ইজিবাইক হলো তখন ভাড়া ৩০/৩৫টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভাড়াও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চালক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায় একটা রুটে যখন যানবাহন কম ছিল তখন যে গাড়িটি দিনে চারটি ট্রিপ বা খ্যাপ দিতে পারতো সেখানে যানবাহন বৃদ্ধির কারণে দিনে ২টি দিতে পারছে। তাই যানবাহনের মালিক ও চালকের ইনকাম ঠিক রাখার জন্য এই দুই খ্যাপের ভাড়া বা ইনকাম দিয়ে যেন পূর্বের চারটি ট্রিপের ইনকামের সমান থাকে তারজন্য যাত্রীর ভাড়া বৃদ্ধি বা সম্বনয় করা হয়। ঈদ,পূজাসহ বিভিন্ন জাতীয় উৎসব ও অন্যান্য উপলক্ষে যখন যাত্রীর অধিক চাপ থাকে তখন ভাড়া কম না নিয়ে উল্টো বেশি নেওয়া হয়। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। আগের চেয়ে দিনদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ শিক্ষা ব্যয় কমছে না বরং বাড়ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু চিকিৎসা খরচ বাড়ছে।জাতীয় মাছ ইলিশ একটি দেশীয় পণ্য এবং কোন উৎপাদন খরচ না হওয়া শর্তেও ইলিশের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। আর এ সকল অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলে বা চলছে রাষ্ট্র -প্রশাসন,আধিপত্য ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সমিতি ও সংগঠনের মাধ্যমে।
অপরদিকে সমাজে যদি ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকত তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না। ইসলামি বাজার ব্যবস্থায় প্রকৃত বিক্রেতা এবং ভোক্তার বা ক্রেতার মধ্যে কোন তৃতীয় পক্ষ বা মধ্য সত্ত্বভোগী থাকার সুযোগ নেই। ইসলামি বাজার ব্যবস্থায় কোন পণ্য উৎপাদনকারী বা প্রকৃত বিক্রেতা যখন পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে তখন প্রকৃত ক্রেতা বা ভোক্তা উভয়ে দরকষাকষির মাধ্যমে পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে। পণ্যের প্রকৃত মালিক প্রথমে পণ্যের দাম চাইবে বা প্রস্তাব করবে তারপর ক্রেতা পণ্যের দাম কত দিতে চায় তাহা বলবে। এক্ষেত্রে ক্রেতার আগে দাম বলার সুযোগ নাই। আল্লাহর রাসুল সাঃ বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন গ্রাম থেকে শহরে কোন পণ্য বিক্রি করার জন্য আসে তখন তোমরা কেউ ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্যের দাম বৃদ্ধি বা কমানোর জন্য দালালি করো না এবং ওজনে কম দিও না,ভালোর সঙ্গে খারাপ এবং খারাপের সঙ্গে ভালো মিশ্রিত করো না। ইসলামে মাল বা পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা, দাম বৃদ্ধি করা এবং অধিক মুনাফা করা নিষেধ। সুতরাং সমাজে যদি ইসলামী অর্থব্যবস্থা থাকে এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহ ভীতি বা তাকওয়া থাকে তাহলে বর্তমান সমাজে দ্রব্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হবেনা। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে এই নীতি ইসলাম পরিপন্থী। কোন ব্যবসায়ী বা বিক্রেতার মধ্যে যদি আল্লাহ ভীতি থাকে তাহলে কোন পণ্যের হঠাৎ চাহিদা বাড়লে ঐ ব্যবসায়ী বা বিক্রেতা সাথে সাথে দাম বৃদ্ধি করতে পারবেনা। সে চিন্তা করবে এই পণ্যের দাম একটু আগে যে দামে বিক্রি করেছি এখন তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে আমার অন্যায় হবে,আমার ক্রয়মূল্য তো বৃদ্ধি হয়নি, ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করা হবে,আমার আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং আমাকে এই প্রতারণার হিসাব দিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ একজন মাংস ব্যবসায়ী সকাল বেলা একটা গরু জবাই করল এবং তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় হিসাব করল এই গরুর মোট মাংস হবে ২০০ কেজি এবং প্রতিকেজি যদি ৬০০ টাকায় বিক্রি করি তাহলে আমার কেজিপ্রতি ২০টাকা মুনাফা হবে।সে এই হিসাবে মাংস বিক্রি করছে, ১৫০ কেজি বিক্রি করার পর সে বুঝতে পারছে বাজারে মাংসের চাহিদা বেশি, ক্রেতা বেশি এমতাবস্থায় সে চিন্তা করছে বাজারে তো আর মাংস নাই, তাই এখন প্রতিকেজি ৮০০ টাকার কমে বিক্রি করবোনা। ক্রেতা সাধারণের কোন উপায় নাই, তাদের মাংস কিনতেই হবে।বাধ্য হয়ে ক্রেতা ৮০০টাকা কেজিতে ক্রয় করল। এই ব্যবসায়ীর নিকট অবশিষ্ট ছিল ৫০ কেজি মাংস, তাকে এখন যদি বলা হয় ৫০০০ টাকা কেজি দিব,আপনি আমাকে ৬০ কেজি মাংস দেন। তারপক্ষে কিন্তু কোন অবস্থায় অতিরিক্ত ১০কেজু বিক্রি করা সম্ভব না,তাই চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ানো সুস্পষ্ট প্রতারণা। সে যদি ৬০০টাকা কেজি দরে বিক্রি করে তাতেও কিন্তু তার মুনাফা হবে এবং সে দিনের শুরুতে টার্গেট নিয়েছিলই কেজিপ্রতি ২০ টাকা লাভ করবে। হঠাৎ যখন চাহিদা বেড়ে গেল তখন তার মধ্যে শয়তানের ধোকা কাজ করা শুরু করল এবং সে শয়তানের ধোঁকায় ধরা দিল।আর এই মাংস ব্যবসায়ী যদি আল্লাহ ভীরু হতো তাহলে সে চিন্তা করতো চাহিদা যাই হোক আমি যে দামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে দামেই বিক্রি করব আর তাতে যা মুনাফা হবে তাই যথেষ্ট। ইসলামে এই অতিরিক্ত ২০০টাকা নেওয়ার কোন সুযোগ নাই ব্যবসায়ীর।
ইসলামী অর্থ ও বাজার ব্যবস্থায় মধ্য সত্ত্ব ভোগী, আড়তদারি, কালোবাজারি, মজুদদারি ইত্যাদি সম্পন্ন নিষিদ্ধ। সর্বপরি একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান সমাজে উদ্ভুত দ্রব্যমূল্যের যে অস্বাবিক পরিস্থিতি এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলামি বাজার ও অর্থব্যবস্থা এবং তাকওয়া।
লেখকঃ মোঃ হাফিজুর রহমান,
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।