চট্টগ্রাম ব্যুরো- চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন জিসান উদ্দীন নামের এক কিশোর। পরিবারের ২ ভাই ১ বোনের মধ্যে জিসানই সবার বড়ো। বাবা আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্র উপকূলে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সমুদ্র থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ভালোই যাচ্ছিলো তাদের জীবন,কিন্তু বাধ সাধে কপালের। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়,এলাকার স্থানীয় চাঁদাবাজ,ভুমিদস্যু ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী দলের চক্র প্রতিনিয়ত জিসান ও তার পরিবারের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিলো। কিন্তু তারা চাঁদাবজির প্রতিবাদ জানিয়ে চাঁদা দিতে অসম্মতি জানালে পরবর্তীতে তাদের কাছে চাঁদা না পেয়ে প্রতিনিয়ত হুমকি দিতে থাকে ওই সন্ত্রাসী দল।
একপর্যায়ে ২০শে মার্চ ২০২৪ সন্ধ্যার পর জিসান উদ্দীন আনোয়ারা উপজেলার জুঁইদন্ডী চৌমুহনী বাজারে গেলে একদল স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী দল তাকে টেনে হিচড়ে অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে এলাপাথারি কোপায়। এসময় জিসান হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্যে চেষ্টা করলে বারবার তাকে কুপিয়ে তার দুই পা এবংএকটি হাতে মারাত্মক জখম করে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ফেলে রাখে।
[caption id="attachment_19170" align="alignnone" width="1200"] আহত জিসান উদ্দীন বিছানায় কাতরাচ্ছে[/caption]
এই ঘটনায় জিসানের সাথে কথা বললে জিসান জানায়, হামলার নেতৃত্ব দেয় আনোয়ারা উপজেলার জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের চান মিয়ার বাড়ির ছৈয়দ আহমদের ছেলে মোক্তার আহমদ। মোক্তার দীর্ঘদিন ধরে জিসান ও তার পরিবারের কাছে চাদা দাবি করে প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে আসছিলো।
জিসান আরো বলেন,‘মোক্তারের ভাই আমার এক বন্ধুকে কোনো কারণ ছাড়াই মারতে আসলে আমি তার প্রতিবাদ জানিয়ে মারামারি করতে দেই নাই। তারপর থেকেই মোক্তার আমার এবং আমার পরিবারের পেছনে উঠে পরে লাগে। জিসান আরো বলেন, মোক্তার এলাকার শীর্ষ ভাড়াটে সন্ত্রাসী তার নামে একাধিক মামালা রয়েছে। সে টাকার জন্যে মানুষ হত্যা করেছে বলেও জানান জিসান। তার এই চক্রের অন্যতম দুই সদস্য যাদেরকে মোক্তার সেকেন্ড ইন কমান্ড করে মাদক ব্যবসা,চাঁদাবজি, হত্যাকান্ড, ভাড়ায় গিয়ে মারপিটসহ নানা ধরণের অপরাধজনিত কর্মকান্ড পরিচালিত করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ২ সদস্য হলেন- জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের বদরুজ্জামানের ছেলে নূর হোসেন (৩১) এবং একই এলাকার মফজল আহমদের ছেলে রবিউল আলম (৩০)।
ছেলের ওপর এমন নৃশংস হামলার পরপরই জিসানের বাবা মোহাম্মদ ইলিয়াছ বাদী হয়ে আনোয়ারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এই বিষয়ে আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল আহাম্মদের সাথে কথা বলতে একধিক বার ফোন করা হলেও তাকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
জিসানের বাবার সাথে কথা হলে তিনি অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে জিসানকে হত্যার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী,চাঁদাবাজ,ভূমিদস্যু,মাদক ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারী চক্রের হোতা মোক্তার তার সন্ত্রাসী দল নিয়ে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে আমার ছোটো ছেলে জানতে পেরে ঘটনাস্থলে দৌড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা আমার ছোটো ছেলেকেও আক্রমণের উদ্দেশ্যে দৌড়ানি দেয়। আমি দেশের আইনী বিচারের ওপর আস্থাশীল। এই ঘটনায় আনোয়ারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছি। আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সুদৃষ্টি কামনা করছি। আমার ছেলেকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা এই হামলা করে। নিশ্চয়ই আমি এর সঠিক বিচার পাবো।’
ঘটনার আদ্যেপান্ত শোনার পর এই বিষয়ে অনুসন্ধান করা হলে জানা যায় অনেক কিছুই। অভিযুক্তদের বক্তব্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে উঠে আসে মোক্তার আহমদের একাধিক চাঞ্চল্যকর মামলার ঘটনা।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ১৭ অক্টোবর ২০১৬ সালে আনোয়ারা উপজেলার খুরুস্কুল এলাকার আইয়ুব আলীর পুত্রকে ৬ হাজার টাকা পাওনা আদায়ের বিষয়ে কথাকাটাকাটি হলে খুরুস্কুল এলাকার নূর আহাম্মদের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) এবং মোক্তার আহমদ তাদের হাতে থাকা লোহার হাতুড়ি এং কিরিচ দ্বারা বাদী আইয়ুব আলীর পুত্র কফিল উদ্দিনের হত্যা করার উদ্দেশ্যে আঘাত করে ঘেটনাস্থলে ফেলে রাখে। পরবর্তীতে আমি সাম মাঝির বাড়ির উত্তর পাশে আব্দুল বাড়ী চেীধুরী সড়কের ওপর ঘটনাস্থলে পৌঁছালে আমার ছেলেকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরবর্তীতে কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে বাদীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে জানা যায়, ছেলে হারানো শোকে ৫/৬ বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেন আইয়ুব আলী।
আইয়ুব আলীর ছোটো ছেলের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মামলার বিষয়ে আমি কিছ জানি না।মামলা পরিচালনাকরী উকিল মারা গেছেন বেশ কয়েক মাস আগে। এখন নতুন উকিল দ্বারা মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। আমার মা এবং চাচা এটার তদারকি করছেন। বাদী এখন আমার মা। এ বিষয়ে নিহত কফিলের মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলে কফিলের ছোটো ভাই জানায় তার মা বার্ধক্য জনিত রোগে অসুস্থ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বললে তানা জানায়, মোক্তারের সিন্ডিকেট অস্ত্র ও মাদকব্যবসার সাথে জড়িত। মোক্তার এগুলোর নেতৃত্ব দেয়। তারা মানুষকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে থাকেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, মোক্তার আহমদ ও তার চক্রের অন্যতম দুই সদস্য নুর হোসেন এবং রবিউল আলমের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রয়েছে।
[caption id="attachment_19175" align="alignnone" width="720"] অভিযুক্ত মোক্তার আহমদের ভ্রমণ চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে আরেক আসামী নূর হোসেন[/caption]
প্রতিবেদনের অনুসন্ধান চলমান অবস্থায় বেশ কয়েকবার ভুক্তোভুগী জিসান ও তার পরিবারের সাথে কথা হলে তারা জানান,জিসানের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তার পায়ে অস্ত্রপ্রচার করতে হবে। আঘাতপ্রাপ্ত হাত-পা আগের মতো স্বাভাবিক আর কখনও হবে না। এক পর্যায়ে জিসানের বাবা বলেন, জিসানকে পঙ্গু করে দিয়েও সন্ত্রাসীরা ক্ষান্ত হয়নি। অভিযুক্ত আসামীরা প্রতিনিয়ত মুঠোফোনে হত্যার হুমকী ও তার পরিবারের সদস্যদের মামলা প্রত্যাহারের জন্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আসছে। এমতাবস্থায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট জিসানের পরিবার আকূল আবেদন করে বলেন, আমরা খুবই ভতি এবং সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন যাপন করছি। কখন আবারও সন্ত্রাসীদের হামলায় আমার পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে ফেলি। তারা প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে মুঠোফোনে। আমরা আইনের সহযোগীতা চাই।নিরাপদে বাচতে চাই।’
গ্রেপ্তারী পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামীদের আটক না করে এভাবে সদর্পে ঘুরতে দেয়ার নেপথ্যের ঘটনা কি তা পাঠকদের জানাতে সরেজমিন বার্তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরবর্তী পর্বের অনুসন্ধান চলছে।