
মাসুম বিল্লাহঃ
যখন যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা বিদেশি অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ আসে, তখন যে দেশের নাম বারবার উঠে আসে, সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবাক করা বিষয় হলো, আমেরিকা তাদের ২৪৮ বছরের ইতিহাসের মধ্যে ২৩২ বছরই যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়েছে। অর্থাৎ, তাদের ইতিহাসের মাত্র ৬ শতাংশ সময় তারা যুদ্ধহীন থেকেছে।
এটা কি কেবলই ইতিহাসের একটি কাকতালীয় ঘটনা? নাকি আমেরিকার রাষ্ট্র কাঠামো, অর্থনীতি এবং রাজনীতির গভীরে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধ-আসক্তির ফল?
অনেক বিশ্লেষকের মতে, আমেরিকার অস্তিত্ব আর আধিপত্য টিকে আছে যুদ্ধ এবং সামরিক হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভর করেই। যুদ্ধ যেন আমেরিকার রাষ্ট্রীয় চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একবার যুক্তরাষ্ট্রকে “যুদ্ধে আসক্ত দেশ” বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেছিলেন, “বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে আমেরিকা।”
ইতিহাসের দিকে তাকালে, এই মন্তব্য হয়তো অমূলক নয়।
১৭৭৫ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, দেশটি কখনো সরাসরি যুদ্ধের, কখনো গোপন অভ্যুত্থান কিংবা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে।
ইতিহাসের পাতায় আমেরিকার যুদ্ধের ধারাবাহিকতা
✅ আধিপত্যবাদী যুদ্ধ
- মেক্সিকোর জমি দখল (১৮৪৬-১৮৪৮)
- আমেরিকান আদিবাসীদের উপর গণহত্যা (১৮১১-১৮৯০)
✅ বিশ্বযুদ্ধ
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ (১৯১৭)
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলা (১৯৪৫)
✅ শীতল যুদ্ধের যুগ
- কোরিয়া ও ভিয়েতনামে সামরিক হস্তক্ষেপ
- ইরানে ১৯৫৩ সালের সরকার পতনে ভূমিকা (অভ্যুত্থান)
✅ একবিংশ শতাব্দীর আগ্রাসন
- আফগানিস্তান ও ইরাক দখল
- লিবিয়ায় যুদ্ধ
- ইয়েমেন, সোমালিয়ায় ড্রোন হামলা
- সিরিয়া, ইউক্রেন সংঘাতে সক্রিয় ভূমিকা
✅ গোপন যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান
- কম্বোডিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র
কেন এই যুদ্ধের এত আগ্রহ?
অর্থনৈতিক স্বার্থ
আমেরিকার অস্ত্র শিল্প বিশ্ব অর্থনীতিতে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে।
শুধু ২০২৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৩৮ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বিক্রির ৫১ শতাংশ-ই আসে আমেরিকান কোম্পানিগুলো থেকে।
যুদ্ধ মানেই নতুন অস্ত্রের বাজার, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ।
ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ, কৌশলগত অঞ্চল, সামুদ্রিক করিডোরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা যুদ্ধের অন্যতম কারণ।
আজকের দিনে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
এগুলো কেবল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নয়, বরং বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের অস্ত্র হিসেবেও কাজ করে।
মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়া
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার মন্তব্য করেছিলেন,
“আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে যুদ্ধপ্রেমী দেশ, কারণ তারা সবসময় নিজেদের মূল্যবোধ অন্যদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।”
এটা শুধু সামরিক নয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনেরও অংশ।
এই যুদ্ধক্ষুধা কি থামবে?
আমেরিকার সম্প্রসারণবাদী নীতি এখনও অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি তাদের পক্ষ থেকে:
- কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার হুমকি,
- পানামা খাল পুনর্দখলের দাবি,
- গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব
এসবই তাদের সম্প্রসারণবাদী মানসিকতার উদাহরণ।
এই প্রকল্পগুলো আপাতত কূটনৈতিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক পরিকল্পনা হিসেবে রয়ে গেলেও, ভবিষ্যতে এগুলোর অনেকটাই সামরিক রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুদ্ধ আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ডিএনএ’র অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা শান্তি চায় না, কারণ যুদ্ধই তাদের আর্থিক সমৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী প্রভাবের প্রধান মাধ্যম।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—
এই পথ কি চিরকাল চলবে?
বিশ্ব কি এই যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে?
নাকি আমেরিকা একদিন যুদ্ধ ত্যাগ করবে?
সবশেষে, আমেরিকার ইতিহাস, নীতি এবং বর্তমান কৌশল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—
শান্তি তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং যুদ্ধই তাদের টিকে থাকার অন্যতম উপায়।
এখন সময় বলবে, এই যুদ্ধমুখী বিশ্বনীতি কতদিন চলবে, আর বিশ্ববাসী কতদিন তা মেনে নেবে।