ধর্ম ডেস্ক :
মুক্তি ও পরিত্রাণের অন্যতম মূলনীতি হলো মিথ্যা, খারাপ কথা, গালাগাল, অপবাদ ও যেকোন খারাপ কাজ বা খরাপর আচরণ থেকে নিজের মুখকে বাঁচিয়ে রাখা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সূরা কাফ : ১৮)। অন্যদিকে রসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শেষ দিবস ও আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে, নয়তো চুপ থাকে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
রসুল (স.) আমাদের নিরাপদ থাকার মূলনীতি বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুখ এবং লজ্জাস্থানের নিশ্চয়তা দেবে আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’ (বোখারি)। আর তাই বিজ্ঞজনরা বলেন, ‘কথা ভালো না হলে মানুষের জন্য কথা বলা উচিত নয়। ভালো কথা বলতে বোঝায় যে কথার উপকারের দিক স্পষ্ট। আর যদি কথায় উপকারের দিক না থাকে তাহলে যেন চুপ থাকে।’ রসুল (স.) বলেন, ‘গুরুত্বহীনভাবে কেউ আল্লাহ তায়ালাকে অসন্তুষ্ট করে এমন কথা বললে সে যেন নিজেকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিল।’ (বোখারি)।
এক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক বিপদ ও জঘন্য অপরাধ হচ্ছে গিবত তথা পরনিন্দা। গিবত হচ্ছে কোনো ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার অপছন্দনীয় কোনো বিষয় উল্লেখ করা। চাই সেটা তার শরীর বা দ্বীন বা দুনিয়া বিষয়ে হোক। অথবা তার চরিত্র, গঠন প্রকৃতি, সম্পদ, সন্তান বা তার পিতা-মাতা বিষয়ে হোক। গিবত মুখে হোক অথবা লিখে বা ইঙ্গিতে অথবা ইশারায়, সবই সমান। গিবতের মতো নিন্দনীয় কাজে দিয়ে নিষেধ করে বান্দাদের সতর্ক করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের গিবত করো না। তোমাদের কেউ কি মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? নিশ্চয় তা তোমরা ঘৃণা করো।’ (সূরা হুজরাত : ১২)। রসুল (স.) এর ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কি?’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুল এ সম্পর্কে ভালো জানেন। তখন রসুল (স.) বলেন, ‘তোমার ভাইয়ের কোনো দোষ ত্রুটি আলোচনা করা যা শুনলে সে মনঃক্ষুন্ন হয়।’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘তার মধ্যে যদি সে দোষ বিদ্যমান থাকে?’ উত্তরে রসুল (স.) বলেন, ‘যদি তার মাঝে সে দোষ বিদ্যমান থাকে তাহলে তুমি গিবত করলে। আর যদি বিদ্যমান না থাকে তাহলে তুমি তাকে অপবাদ দিলে।’ (মুসলিম)।
ইসলামি শরিয়তে একজন মোমিনের মান-সম্মান সংরক্ষিত। অতএব কারও অনুপস্থিতিতে সে অপছন্দ করে এমন বিষয় আলোচনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রসুল (স.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘এ মাসের সম্মানের মতো, এ দিনের সম্মানের মতো তোমাদের মান-সম্মান, সম্পদ ও রক্ত সম্মানিত।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
অতএব যে ব্যক্তি মুসলমানের সম্মান বিনষ্টে নিজ মুখ ব্যবহার করেছে সে যেন রসুল (স.) আয়েশা (রা.) কে যে কথা বলেছেন তা যেন স্মরণ করে। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রসুল (স.) কে বললাম, ‘সফিয়ার এই এই সমস্যা আছে। অর্থাৎ সে খাটো।’ তখন রসুল (স.) বললেন, ‘তুমি এমন একটি জঘন্য কথা বলেছ তা যদি সাগরের পানির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা সমুদ্রকে পরিবর্তন করে ছাড়বে।’ আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রসুল (স.) এর কাছে মানুষের বর্ণনা দিলাম।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি কারও সম্পর্কে গল্প করা পছন্দ করি না, যদিও আমাকে এরূপ এরূপ (সম্পদ) দেওয়া হয়।’ (তিরমিজি)। ইমাম নববি (র.) বলেন, ‘গিবতের ব্যাপারে এই হাদিসটি অনেক বড় ধমক ও হুমকি। এ ব্যাপারে এর চেয়ে ভয়াবহ হাদিস আমার জানা নেই।’
গিবত ধ্বংস ডেকে আনে। গিবতকারীর জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি এবং যন্ত্রণাদায়ক আজাব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহজাব : ৫৮)। রসুল (স.) বলেন, ‘মেরাজের রজনীতে যখন আমাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করি। তাদের নখ ছিল পিতলের, তা দিয়ে তারা তাদের চেহারা ও বুক ছিঁড়ছে। আমি জিবরাইল (আ.) কে জিজ্ঞেস করালাম, তারা কারা?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘তারা মানুষের গোশত খেত (অর্থাৎ গিবত করত) এবং মানুষের মানসম্মান নিয়ে তামাশা করত। (আবু দাউদ)।
মোমিনের জন্য তার কাছে কেউ গিবত করুক এমন অনুমতি দেওয়াও উচিত নয়। অনেক সময় দেখা যায় অনেকে নিজে গিবত করে না, তবে গিবতের সুযোগ দেয়। এটিও হারাম। তেমনিভাবে গিবত শোনা, তা সমর্থন করাও হারাম। বরং ওয়াজিব হচ্ছে শরয়ি নীতি অনুযায়ী গিবতকারীকে বাধা দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আপনি তাদের দেখেন, যারা আমার আয়াতগুলোতে ছিদ্রান্বেষণ করে, তখন তাদের কাছ থেকে সরে যান যে পর্যন্ত তারা অন্য কথায় প্রবৃত্ত না হয়।’ (সূরা আনআম : ৬৮)। রসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্মান রক্ষা করবে। আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার মুখকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।’ (তিরমিজি)।
তবে গিবত ব্যতীত সম্ভব নয় এমন শরিয়তসম্মত প্রয়োজনে গিবতের অবকাশ রয়েছে। যেমন, কেউ যদি তার ন্যায্য অধিকার পেতে জালেমের বিরুদ্ধে গিবত করে অথবা কোনো কারণে কেউ পরামর্শ চাইলে তখন সে যা জানে তা উল্লেখ করবে।
প্রিয় ভাইয়েরা, সব গোনাহ ও অপরাধ থেকে তওবা করুন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী গিবত থেকে তওবা করার জন্য যার গিবত করা হয়েছে তার কাছে বলতে হবে। যদি সে জানে তাহলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। আর যদি গিবত সম্পর্কে না জানে অথবা তাকে জানালে আরও বড় কোনো ফ্যাসাদ বা ফেতনা হবে বলে মনে হয় তখন তার জন্য মাগফিরাত ও কল্যাণের দোয়া করবে, যা কিছু জানা আছে সে মর্মে তার কল্যাণকর দিকগুলো উল্লেখ করবে। যে সব মজলিসে তার গিবত করা হতো সে সব স্থানে তার ভালো দিকের কথা বলবে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাঈমিয়্যাহ (র.), তার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম (র.)সহ অধিকাংশ আলেমের মত এটিই। আল্লাহ তায়ালা যার নিয়তের সত্যতা এবং ইখলাছ সম্পর্কে জানবেন তার ওপর দয়া, মায়া ও অনুগ্রহ করে তার জন্য তওবার সব পথ ও মাধ্যম সহজ করে দেবেন।
© 2013 All Rights Reserved By সরজমিনবার্তা
0 Comments